প্রশ্ন:- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।
আপাত দৃষ্টিতে নৌ-বিদ্রোহ ব্যর্থ মনে হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলনের সূদুর প্রসারী গুরুত্ব ছিল, যেমন—
(১) বিদ্রোহীদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন,
(২) প্রথম বারের জন্য সৈনিক ও সাধারণ মানুষের রক্ত রাজপথে প্রবাহিত,
(৩) পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে অসন্তোষের চিহ্ন,
(৪) ব্রিটিশ সরকারের উপলব্ধি— 'বল প্রয়োগে ভারতকে আর পদানত রাখা সম্ভব নয়' ।
এইভাবে নৌ-বিদ্রোহ ভারতকে স্বাধীনতা লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ।
বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ভারতবর্ষ এক সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ক্রমবর্ধমান খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব, মজুতদারি, কালোবাজারি, শিল্পে মন্দা, কর্মীছাঁটাই, বেকারি প্রভৃতি অর্থনৈতিক কারণ ভারতের সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারতছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতা ও কঠোর সরকারি দমননীতির ফলে ভারতের ছাত্র সমাজ ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত ও ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় মুখর হয়ে ওঠে । এই সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত সময়ে ভারতের নানা প্রান্তে একের পর এক ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ দেখা দেয় । এই সমস্ত ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলনই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ।
(১) আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দী সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন :
(ক) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর দিল্লীর লালকেল্লায় গঠিত বিশেষ সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযুক্ত সেনাদের প্রকাশ্য বিচার শুরু হলে তার প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন 'বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস', ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ফেডারেশন’ এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে নভেম্বর ইসলামিয়া কলেজ বর্তমান মৌলনা আজাদ কলেজের বিশাল ছাত্র মিছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে যেতে গিয়ে পুলিশের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হলে ধর্মতলা স্ট্রিট বর্তমান লেনিন সরণি রাস্তা অবরোধ করে ।
(খ) সন্ধ্যাবেলায় সেই ছাত্র সমাবেশের ওপর পুলিশের গুলিতে 'ক্যালকাটা টেকনিক্যাল স্কুলের’ রামেশ্বর চট্টপাধ্যায় নামে জনৈক ছাত্র নিহত হয় এবং অনেক ছাত্র আহত হয় ।
(গ) এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ও ২৩শে নভেম্বর কলকাতায় ধর্মঘট পালিত হয় এবং গাড়িতে আগুন লাগানো চলতে থাকে । পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে পুলিশ অন্তত ১৫ বার গুলি চালায় । এই প্রসঙ্গে বাংলার তৎকালীন গভর্নর কে.সি বড়লাট লর্ড ওয়াভেল -কে পাঠানো তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন ‘খুবই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ছাত্রদের ওপর গুলি চালালেও তারা দাঁড়িয়েই থাকছে, বড়োজোর একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার আক্রমণ করছে ।
(২) রশিদ আলি দিবসে ছাত্র আন্দোলন :
(ক) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জনৈক সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করলে তাঁর মুক্তির দাবিতে মুসলিম ছাত্র লিগ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় । সমস্ত ছাত্র সংগঠন এই ছাত্র ধর্মঘট সমর্থন করে;
(খ) ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে বিশাল ছাত্র মিছিল এগিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে তার প্রতিবাদে পরের দিন অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ খ্রি. রশিদ আলি দিবসে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় । এই কয়েক দিনে আইন-শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি পুলিশের আয়ত্বের বাইরে চলে যায় । আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী ডাকতে হয় । পুলিশ ও মিলিটারির গুলিতে সরকারি হিসাবে ৮৪ জন নিহত ও ৫০০ জন আহত হয় । বেসরকারি মতে, আহত ও নিহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি ।
*****