ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পটভূমি - দ্বিতীয় পর্যায় :
Background of communal politics
ইতিমধ্যে মহম্মদ আলি জিন্না ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করলে একটি নতুন যুগের সুচনা হয় । মহম্মদ আলি জিন্না প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । পরে তিনি কংগ্রেসকে মুসলিমদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে বলেন । মহম্মদ আলি জিন্না ও বালগঙ্গাধর তিলকের চেষ্টায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে লখনউ চুক্তি সম্পাদিত হয় । কংগ্রেস কেন্দ্রীয় আইন সভায় মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন ছেড়ে দিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি মেনে নেয় । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে খিলাফৎ প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আরও একবার কংগ্রেস-খিলাফৎ ঐক্য সম্পাদিত হয় । কংগ্রেস এবং গান্ধিজি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক আন্দোলন খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন । কিন্তু মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষিত হলে খিলাফৎ প্রশ্ন গুরুত্ব হারায় এবং সেই সঙ্গে খিলাফৎ আন্দোলনের অবসান হয় । মুসলিম লিগ পুনরায় তার সাম্প্রদায়িক অবস্থানে ফিরে আসে ।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে স্বরাজ্য দল এবং মুসলিমগণ স্বতন্ত্রভাবে আইন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল । কিন্তু কেন্দ্রীয় আইনসভায় কোনো পক্ষই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে নি । স্বরাজ্য দল ৩০ জন মধ্যপন্থী মুসলিম নেতার সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন করে । এই কোয়ালিশন 'জাতীয় দল' নামে পরিচিত হয় । এটি 'বেঙ্গল পার্টি' নামে পরিচিত । এই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অবশ্য স্থায়ী হয় নি । স্বরাজ্য দলের ব্যর্থতার পর ভারত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে পড়ে । মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম লিগকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন । লিগের নেতৃত্বে মুসলমানদের আন্দোলন স্বতন্ত্র খাতে প্রবাহিত হতে থাকে । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বিরোধী বিক্ষোভে আরও একবার কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ একত্রিত হয়েছিল । এ ছাড়া ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সর্বদলীয় সম্মেলনে মুসলিম লিগ যোগদান করেছিল । এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতে এক সর্বজনগ্রাহ্য সংবিধান রচনা করা । মুসলিম লিগ মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে রচিত নেহরু সংবিধান প্রথমটায় সমর্থন জানালেও সর্বদলীয় মুসলিম সম্মেলনে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর এক বৈঠকে এই রিপোর্ট গ্রহণে অসম্মত হয় । মহম্মদ আলি জিন্না প্রথম থেকেই মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে রচিত নেহরু সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন । মুসলমান এবং ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলির মিলনের তিনি তীব্র বিরোধিতা করেন । এরপর নেহরু সংবিধানের বিকল্পরূপে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে মার্চ মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম লিগের দিল্লি অধিবেশনের সভাপতিরূপে মুসলিম সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোদ্দ দফা দাবি উত্থাপন করেন । দাবিগুলি সবই সাম্প্রদায়িক যথা—
(১) ভারতবর্ষে একটি যুক্তরাষ্ট্রীর শাসন ব্যবস্থা চালু করতে হবে ।
(২) এই যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্য মাত্রেরই সমান অধিকার থাকবে ।
(৩) প্রত্যেক নির্বাচিত সংস্থায় মুসলমান সম্প্রদায়ের উপযুক্ত সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে ।
(৪) কেন্দ্রীয় আইনসভায় অন্তত এক তৃতীয়াংশ মুসলমান সদস্য নিতে হবে ।
(৫) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি চালু করতে হবে ।
(৬) ভারতীয় প্রদেশগুলির পুনর্গঠন করতে হবে, কিন্তু এই পুনর্গঠনের ফলে বাংলা, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি প্রদেশে মুসলমান অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাতে ব্যাহত না হয় তা দেখতে হবে ।
(৭) যে কোনো সম্প্রদায়ের ৩/৪ ভাগ সদস্যের বিরোধিতায় যে কোনো বিল বাতিল করার অধিকার থাকবে,
(৮) সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতিদান,
(৯) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার মোট সদস্যর ১/৩ ভাগ সদস্য মুসলিমদের মধ্য থেকে নিয়োগ
(১০) সংবিধান পরিবর্তনের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার সম্মতি অবশ্যই নিতে হবে ।
(১১) বোম্বাইকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন সিন্ধু প্রদেশ গঠন ।
(১২) বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সাংবিধানিক সংস্কারের ব্যবস্থা করা ।
(১৩) রাজ্য ও স্থানীয় সংস্থায় মুসলিমদের জন্য পদ সংরক্ষণ করা
(১৪) মুসলিম সমাজের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষাদীক্ষার প্রতি লক্ষ দেওয়া ।
কংগ্রেসের পক্ষে মহম্মদ আলি জিন্নার চোদ্দ দফা দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি । ফলে জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ সর্বদলীয় সম্মেলন বর্জন করেন । জিন্নার চৌদ্দ দফা দাবি ঘোষণার পর থেকে রাজনৈতিক সংকট ও হিন্দু-মুসলিম ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
*****
- 1442 views