ছাত্র আন্দোলন (Student Movement) :
ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ছাত্রদল সব সময়ই পুরোভাগে ছিলেন । বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ভারতবর্ষ এক সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ক্রমবর্ধমান খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব, মজুতদারি, কালোবাজারি, শিল্পে মন্দা, কর্মীছাঁটাই, বেকারি প্রভৃতি নানান অর্থনৈতিক কারণে ভারতের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতা ও কঠোর সরকারি দমননীতির ফলে ভারতের ছাত্র সমাজ ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত ও ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় মুখর হয়ে ওঠে । এই সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত সময়ে ভারতের নানা প্রান্তে একের পর এক ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ দেখা দেয় । এই সমস্ত ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলনই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য । ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর দিল্লির লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার শুরু হলে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদে সোচ্চার হন । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন রশিদ আলির বিচারের সময় কলকাতার ছাত্র আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে । এই আন্দোলনে হিন্দু, মুসলমান, কৃষক, শ্রমিক, মজদুর সবাই অংশ নিলে ছাত্র আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ নেয় । পুলিশের গুলিতে কতিপয় ছাত্র প্রাণ হারান । ১০ই ফেব্রুয়ারি দিনটি রশিদ আলি দিবস রূপে উদযাপিত হয় । পরবর্তী ১১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত ছিল ।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দী সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন :
(ক) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর দিল্লীর লালকেল্লায় গঠিত বিশেষ সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযুক্ত সেনাদের প্রকাশ্য বিচার শুরু হলে তার প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে নভেম্বর কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস’, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ফেডারেশন’ এবং ইসলামিয়া কলেজের বর্তমানে মৌলনা আজাদ কলেজর বিশাল ছাত্র মিছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে যেতে গিয়ে পুলিশের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হলে ধর্মতলা স্ট্রিট বর্তমানে লেনিন সরণি অবরোধ করে ।
(খ) সন্ধ্যাবেলায় সেই ছাত্র সমাবেশের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ‘ক্যালকাটা টেকনিক্যাল স্কুলের’ রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায় নামে জনৈক ছাত্র নিহত হয় এবং অনেক ছাত্র আহত হয় ।
(গ) এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ও ২৩শে নভেম্বর কলকাতায় ধর্মঘট পালিত হয় এবং গাড়িতে আগুন লাগানো চলতে থাকে । পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে পুলিশ অন্তত ১৫ বার গুলি চালায় । এই প্রসঙ্গে বাংলার তৎকালীন গভর্নর কে.সি বড়লাট লর্ড ওয়াভেল -কে পাঠানো তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন ‘খুবই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ছাত্রদের ওপর গুলি চালালেও তারা দাঁড়িয়েই থাকছে, বড়োজোর একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার আক্রমণ করছে । পুলিশ কয়েকজন ধর্মঘটী ছাত্রকে গুলি করে মারলে সারা কলকাতার শিল্পশ্রমিক, মজুররা ২২শে নভেম্বর ছাত্র আন্দোলনে সামিল হয় ।
রশিদ আলি দিবসে ছাত্র আন্দোলন :
(ক) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জনৈক সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করলে তাঁর মুক্তির দাবিতে মুসলিম ছাত্র লিগ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় । সমস্ত ছাত্র সংগঠন এই ছাত্র ধর্মঘট সমর্থন করে;
(খ) ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে বিশাল ছাত্র মিছিল এগিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে তার প্রতিবাদে পরের দিন অর্থাৎ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি রশিদ আলি দিবসে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় । এই কয়েক দিনে আইন-শৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতি পুলিশের আয়ত্বের বাইরে চলে যায় । আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী ডাকতে হয় । পুলিশ ও মিলিটারির গুলিতে সরকারি হিসাবে ৮৪ জন নিহত ও ৫০০ জন আহত হয় । বেসরকারি মতে, আহত ও নিহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি ।
*****
- 9038 views