শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলন (Trade Union Movement and Peasants Movement)
শ্রমিক আন্দোলন (Trade Union Movement) : ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে মোজাফফর আহমেদ 'ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি' (CPI) গঠন করেন । নলিনী গুপ্ত, অবনী মুখার্জি, পি.সি. যোশি, সৌকত ওসমানি, মকবুল হুদা প্রমুখ ব্যক্তিগণ এই কমিউনিস্ট দল গঠনে মোজাফফর আহমেদকে সাহায্য করেছিলেন । কমিউনিস্ট দল গঠনের পর কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ভারতে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে । ভারতে শিল্পায়ন দেরিতে হওয়ার জন্য শ্রমিক আন্দোলন দেরিতে শুরু হয় । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ভারতের শ্রমিক শ্রেণিকে এক নতুন আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে একাধিক শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয় । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বোম্বাই-এর সুতো কলগুলির শ্রমিকগণ মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পরপর ৩০টি শ্রমিক ধর্মঘট করেন । এই ধর্মঘটের প্রভাবে শ্রমিকদের মজুরির পরিমাণ কিছুটা বেড়েছিল । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই -এ আবার ১১ দিন ব্যাপী এক ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয় । বোম্বাই -এর সুতি মিল, বন্দর, কারখানা, টাঁকশাল প্রভৃতি কর্মক্ষেত্রের প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক এই ধর্মঘটে যোগদান করেছিল । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর বোম্বাইতে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নামে একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় । লালা লাজপত রায় এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন । বি. পি. ওয়াদিয়া, এন. এম. যোশী, জোশেফ ব্যাপ্তিস্তা প্রমুখ ব্যক্তিগণ এই কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিলেন । পরে মার্কসবাদী নেতৃবৃন্দ যথা— মুজাফফর আহমেদ, নলিনী গুপ্ত, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা জর্জ এলিসন প্রমুখ এর সঙ্গে যুক্ত হন । এলিসনের উত্তরসুরি ফিলিপ স্প্রাট কৃষকদের এই দলের সঙ্গে যুক্ত করে এর নতুন নাম দেন বোম্বাই মজদুর ও কৃষক দল । বোম্বাই -এর অনুকরণে পাঞ্জাব ও যুক্ত প্রদেশে অনুরূপ শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় ।
আইন অমান্য আন্দোলনে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যেমন—
(১) আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বোম্বাই বন্দরে শ্রমিক আন্দোলনের ফলে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি পণ্য বন্দরে আটকে পড়ে ।
(২) দেশের আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে ।
(৩) বোম্বাইয়ে অনেকগুলি ব্রিটিশ পরিচালিত সুতাকল বন্ধ হয়ে যায় ।
(৪) সর্বোপরি স্বদেশি খাদি বস্ত্রের উৎপাদন ও বিক্রি অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় ।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের যে স্বতঃস্ফূর্ত চেহারা দেখা গিয়েছিল, বিশেষ কিছু স্থান ও সময় ছাড়া আইন অমান্য আন্দোলনের সময়ে তা দেখা যায়নি ।
কৃষক আন্দোলন (Peasants Movement) : শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি তিরিশের দশকে কৃষক আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিল । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সমাজবাদীদের প্রচেষ্টায় এবং ই. এম. এস. নাম্বুদ্রিপাদের পরামর্শ অনুসারে নিখিল ভারত কিষাণ সভা প্রতিষ্ঠিত হয় । লখনউতে এই সভার অধিবেশন বসেছিল । বিহারের কৃষক নেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী এই সভায় সভাপতিত্ব করেন । এই সভায় সরকারের উদ্দেশ্যে কিছু দাবিদাওয়া পেশ করা হয়, যথা—
(১) কৃষি ঋণ মুকুবের দাবি,
(২) ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সরকারি খাস জমি বিতরণ,
(৩) জমিদারি প্রথার বিলোপসাধন,
(৪) কৃষকদের জমির স্বত্ব নিরূপণ করা,
(৫) সেচ ও বীজের সুবন্দোবস্ত প্রভৃতি ।
জাতীয় কিষাণ সভার অধীনে প্রাদেশিক ও জেলা কিষাণ সভা স্থাপিত হয় । ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক আইন সভাগুলির নির্বাচনে সাধারণ নির্বাচন ক্ষেত্রসমূহে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে । এগারোটি প্রদেশের মধ্যে সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম হয় । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা গঠিত হলে কংগ্রেসের সহায়তায় কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কৃষক আন্দোলন কিছু দিনের মতো স্তিমিত হয়ে পড়ে ।
*****
- 13941 views