স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাব (Two-Nation Theory)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 08/19/2013 - 22:00

স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কারণ—

(ক) দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ -র পূর্ব পুরুষরা মোগল যুগে পারস্য বা তুরাণ থেকে ভারতে আসেন । এঁরা ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ‘আশরফ’ বা ‘অভিজাত শ্রেণি’ । তিনি নিজে অভিজাত বংশের জন্য গর্ব বোধ করতেন ও মনে করতেন, ভারতের শাসনব্যবস্থায় অভিজাত বংশীয় মুসলমানদের উচ্চপদ লাভের জন্মগত অধিকার আছে এবং একমাত্র তারাই ভারতের শাসকশ্রেণি হওয়ার যোগ্য ।

(খ) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যখন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রচার করে, স্যার সৈয়দ আহম্মদ আশঙ্কা করেন যে, কংগ্রেসি আন্দোলনের ফলে মুসলিম অভিজাতরা ভারতের শাসনব্যবস্থায় তাঁদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন । এই কারণেই তিনি কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেস বিরোধীতার পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাব:-

তিরিশের দশকে ভারতের জাতীয় রাজনীতি যখন গতিশীল ও গণমুখি হয়ে উঠছিল সেই সময় মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে । প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব সাফল্যে মুসলিম লিগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্না বিচলিত হয়ে পড়েন । তখন তিনি মুসলিম লিগকে মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে থাকেন ।

(ক) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনীতিতে বিভেদপন্থী নীতি গ্রহণ করে । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি পদত্যাগ করলে মহম্মদ আলি জিন্না উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন এবং তিনি 'মুক্তি দিবস' (Day of Deliverence) উদযাপনের ডাক দেন ।

(খ) এরপর মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে নিয়ে ভারতীয় মুলমানদের জন্য একটি পৃথক সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায় । ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে মহম্মদ আলি জিন্না পাকিস্তান দাবির প্রস্তাব উপস্থাপন করেন । স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত । অবশ্য মুসলিম লিগের লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কথাটি ছিল না ।

(গ) মুসলিম লিগের ‘লাহোর প্রস্তাব’ সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন জোগায় এবং ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে । কিন্তু দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় স্বাধীন মুসলিম অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা করা হয় ।

(ঘ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লিগের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে । এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম লিগের সাংগঠনিক শক্তি ক্রমশ প্রসারিত করতে থাকে ।

(ঙ) পরবর্তী সময়ে লর্ড ওয়াভেল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহেরুকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে সেই প্রস্তাবে কংগ্রেস তার সন্মতি জানায় । এই ঘটনায় উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট সমগ্র ভারতে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ রূপে পালিত হয় । ওই দিন কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধে এবং এর পর থেকে ভারতের অন্যত্রও সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়ে পড়ে ।

(চ) আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তান আন্দোলনে জয়যুক্ত হলেও মহম্মদ আলি জিন্না কাঁটার মুকুট পরেছিলেন । তিনি চেয়ে ছিলেন সমগ্র বাংলা ও পাঞ্জাব আত্মসাৎ করতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে শুধুমাত্র ভারত বিভাগ নয়, বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগও মেনে নিতে হয়েছিল । মুসলিম লিগ অনুসৃত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সম্মুখে এক নিদারুণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল এবং ভারতীয় রাজনীতিকে জটিল করে তুলে ছিল ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দিকে এই নীতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটায়

(১) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলনের সময় মুসলিমদের সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে । এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম লিগের সাংগঠনিক শক্তি ক্রমশ প্রসারিত করতে থাকে ।

(২) পরবর্তী সময়ে লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহেরুকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে কংগ্রেস সম্মতি জানায় । এই ঘটনায় উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট সমগ্র ভারতে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ রূপে পালিত হয় । ওই দিন কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধে এবং এরপর থেকে ভারতের অন্যত্রও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ।

(৩) এদিকে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে মুসলিম লিগ বড়লাটের অনুরোধে এই সরকারে যোগদান করলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সদস্যরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সক্ষম হয় নি । ফলে সরকারি প্রশাসনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ।

মুসলিম লিগ কেন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করে

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট বড়লাট লর্ড ওয়াভেল জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহেরুকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তাতে সন্মতি জানায় । এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ রূপে পালিত হয় । ওই দিন কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধে এবং সেখান থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আগুন ভারতের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে । ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলিম’ দুটি পৃথক ধর্মের নাম নয়, ভারতে বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলিমরা হল দুটি পৃথক জাতি । এই ধরনের বক্তব্যই দ্বিজাতিতত্ত্ব নামে পরিচিত । স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ বপন করলেও পরবর্তী কালে মহম্মদ আলি জিন্না পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে এই তত্ত্ব প্রচার করেন ।

*****

Related Items

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (The Calcutta Science College) :-

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাংলায় স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে । এই সময় স্বদেশি বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মা

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of science) :-

কায়েমী স্বার্থরক্ষাকারী ও প্রভূত্ববাদী ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানচর্চার প্রেক্ষাপটে ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞ

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ (Development of Science and Technical Education in Bengal):-

ব্রিটিশ সরকার ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের বিভিন্ন অফিস-আদালত প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কাজের প্রয়োজনে আধুনিক পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মচারীর প্রয়োজন

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ রায় অ্যান্ড সন্স

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (Initiatives Taken by Upendrakishor Roy Choudhury and the U.

ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ

ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ (Press as a Commercial Venture) :

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনবিংশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য ছাপাখানা স্থাপিত হয় । ছাপাখানার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ছাপাখানা কেন্দ্রিক মুদ্রণশিল্প একটি