উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (Initiatives Taken by Upendrakishor Roy Choudhury and the U. Ray & Sons):-
বাংলার মুদ্রণশিল্পের আধুনিকীকরণের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবনে এবং 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স' কোম্পানির প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল । নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে উনবিংশ শতকে তিনি নিম্নমানের মুদ্রণশিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়ে মুদ্রণশিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন । উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একাধারে একজন শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর, আলোকচিত্রী, প্রকাশক এবং মুদ্রক । ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মে ঔপনিবেশিক ভারতের অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত মসুয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । প্রযুক্তিবিদ্যা এবং ফটোগ্রাফির সাহায্য নিয়ে প্রতিচ্ছবি ছাপার কাজে তাঁর মৌলিক অবদান ও হাফটোন ফটোগ্রাফি বিষয়ে গবেষণা তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে । মুদ্রণশিল্পে এবং হাফটোন ফটোগ্রাফিতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান আজও প্রাসঙ্গিক । তাঁকে ভারতের উন্নতমানের হাফটোন ছবির পথিকৃৎ বলা হয় । বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি ছাপার কাজের মানকে আরও উন্নত করার ব্যাপারে সবসময় আগ্রহী এবং যত্নশীল ছিলেন ।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিদেশ থেকে আধুনিক উন্নত মুদ্রণযন্ত্র এনে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন । ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানের নাম হয় 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স' । ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের ভাই প্রমদারঞ্জনের কন্যা লীলা মজুমদার লিখেছেন "১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছাপার কাজ ও ছবি এনগ্রেভ করা সম্বন্ধে তাঁর এতখানি শেখা ও জানা হয়ে গিয়েছিল, এতখানি দক্ষতা ও নিজের ওপরে একটা বিশ্বাস এসেছিল যে সাহস করে নিজের পয়সায় বিলেত থেকে কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে নিজের ছাপাখানার কাজ শুরু করে দিলেন । এইভাবে সেকালের বিখ্যাত ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের গোড়া পত্তন হল" ।
ছাপার ব্লকের ব্যাপারে হাফটোন ব্লকের ব্যবহার হল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর স্মরণীয় কৃতিত্ব । তাঁর আঁকা ছবি হাফটোনে ছাপা হয় তাঁর 'সেকালের কথা' গ্রন্থে । তাঁর তৈরি ব্লক থেকে 'প্রদীপ', 'মুকুল', 'সখা ও সাথী' প্রভৃতি পত্রিকায় ভারতীয় মনীষীদের পুরো পাতা জুড়ে ছবি ছাপা শুরু হয় । পেনরোজ অ্যানুয়াল পত্রিকায় হাফটোন ব্লক তৈরি সম্পর্কে তিনি মৌলিক প্রবন্ধ লেখেন । বাঙালিদের মধ্যে প্রথম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী একটিমাত্র আয়তাকার ৬০ ডিগ্রি স্ক্রীন ও কয়েকটি ডায়াফ্রামের সাহায্যে থ্রি কালার হাফটোন ছবির নেগেটিভ তৈরি করেন । তিনি যান্ত্রিকভাবে স্ক্রীন দূরত্ব নির্ণয় করার জন্য 'স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর' নামে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন । ফটোগ্রাফাররা এই যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই কম খরচে নেগেটিভ তৈরি করতে পারে ।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রথম বই 'টুনটুনির বই' প্রকাশিত হয় । বইটির ভিতরে অজস্র ব্লক ও প্রচ্ছেদে একটি রঙিন হাফটোন ছবি দেখা যায় । তাঁর লেখা 'ছেলেদের মহাভারত', 'ছেলেদের রামায়ণ' প্রভৃতি শিশুপাঠ্য গ্রন্থে তিনি হাফটোন ছবির ব্যবহার করেন । ১৩২০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ তাঁর সম্পাদনায় বত্রিশ পৃষ্ঠাসংখ্যার একটি কিশোরপাঠ্য মাসিক পত্রিকা 'সন্দেশ' প্রকাশিত হয় । পরবর্তীকালে উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার রায় এই পত্রিকা সম্পাদনার ভার নেন । তারপর একে একে সুবিনয় রায়, সত্যজিৎ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, নলিনী দাস, বিজয়া রায়, সন্দীপ রায় প্রমুখ এই পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন । আধুনিক ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণশিল্প সম্পর্কে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে পুত্র সুকুমার রায়কে তিনি ইংল্যান্ডে পাঠান । পিতার মৃত্যুর পর পুত্র সুকুমার রায় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স -এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন । মুদ্রণ বিষয়ে বিলেত থেকে শিক্ষালাভ করে তিনি ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ব্যবসার কাজ এগিয়ে নিয়ে যান । সুকুমার রায় প্রসেস পদ্ধতিতে ক্যামেরার কাজের সহায়ক স্লাইডিং ক্যালকুলেটর উদ্ভাবন করেন । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স সংস্থাটির অবলুপ্তি ঘটে ।
*****