স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন (Boycott and Swadeshi Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 10:33

স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন (Boycott and Swadeshi Movement) :

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে লর্ড কার্জন সিমলায় বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে বাংলায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় । বাংলার বিভিন্ন স্তরের মানুষ এবং পত্রপত্রিকাগুলি ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন । কার্জন তাঁর সিমলা ঘোষণায় "বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত" বলে উল্লেখ করলে তার উত্তরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দৃঢ়ভাব জানিয়েছিলেন "আমি এই অনড় সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটাবই" । বাংলার মানুষের সমস্ত প্রতিবাদ, ধিক্কারকে অগ্রাহ্য করে লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ব্যাপারে অনড় থাকেন । ফলে সমগ্র বাংলা ওই দিন প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাব অনুসারে ওই দিন সাম্প্রদায়িক সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক স্বরূপ 'রাখিবন্ধন উৎসব (Rakhi Bandhan Utsav)' পালন করা হয় । রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর পরামর্শে বাঙালির ঐক্যের নিদর্শন স্বরূপ ঘরে ঘরে 'অরন্ধন' (Arandhan) পালিত হয় । হাটবাজার, দোকানপাট, স্কুল কলেজ, আদালত বন্ধ থাকে । বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা ও ধর্মঘটে সামিল হন । বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমে ব্যাপক গণ আন্দোলনের রূপ লাভ করে । সরকার আন্দোলনকারীদের কন্ঠরোধ করার জন্য কঠোর দমননীতি অনুসরণ করেন  । জাতীয়তাবাদী পত্রপত্রিকার কন্ঠরোধ করা হয় । সরকারি আদেশে যুগান্তরের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় । ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জাগ্রত করার অভিযোগে 'সন্ধ্যা' পত্রিকার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে অভিযুক্ত করা হয় । আর এক পত্রিকা 'বরিশাল হিতৈষী' সরকারি দমননীতির কবল পড়ে । এতেও গণরোষ প্রশমিত না হওয়ায় সরকার কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন । এই সময় কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জুলাই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সামগ্রিক বয়কট আন্দোলনের আহ্বান জানানো হয় । তিনি দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান । তাঁর এই বয়কট ও স্বদেশি আদর্শ দেশবাসীর অন্তরে বিপুল সাড়া জাগায় । 

বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলন (Boycott and Swadeshi Movement) :

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন নামে খ্যাতি লাভ করে । এই আন্দোলনের যুগ্ম চরিত্রের একটি স্বদেশি ও অন্যটি বয়কট নামে পরিচিত । ‘স্বদেশি’ ও ‘বয়কট’ ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র । ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায় ‘‘বয়কট’ ও স্বদেশি’ একে অন্যের পরিপূরক ।

(ক) বয়কট (Boycott Movement) : ‘বয়কট’ কথার অর্থ হল বর্জন । ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখ্য কর্মসূচি ছিল বয়কট । বয়কটের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের দ্বারা ব্রিটিশ পুঁজির উপর আঘাত হানা । তাহলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা সরকারের উপর বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য চাপ সৃষ্টি করবে । বয়কট কার্যকর হলে স্বদেশি দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, দেশীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে, স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারে মৃতপ্রায় শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটবে । সর্বোপরি স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ আত্মত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারে অভ্যস্ত হবে এবং মানুষের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে । বয়কট অর্থে শুধু মাত্র বিলাতি বস্ত্র বা পণ্যসামগ্রীই নয়, বিলাতি চিন্তাধারা, আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থ্যা, আইন ব্যবস্থা, পৌরসভা, আইনসভা প্রভৃতি সব কিছুই বয়কটের মাধ্যমে বর্জন করার আদর্শ প্রচারিত হয় । প্রথমে বিলাতি পণ্যসম্ভার বিশেষত সুতিবস্ত্র বর্জন করা ব্য়কট আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল, পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বয়কট করা হয় । এমনকি ইংরেজি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কটও শুরু হয় ।

(খ) স্বদেশি (Swadeshi Movement) : বয়কটের পরিপূরক হিসেবে স্বদেশি চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে । স্বদেশির অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘কেবল স্বদেশি দ্রব্যই নহে, সর্বপ্রকার বিদেশি আদর্শের পরিবর্তে জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষাপদ্ধতি এবং রাজনৈতিক আদর্শ, লক্ষ্য ও পন্থা জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করে’। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে ‘স্বদেশি’ কথার অর্থ ছিল বিলাতি জিনিসপত্র ও চিন্তাধারার বদলে দেশীয় জিনিসপত্র ও চিন্তাধারাকে গ্রহণ করার নীতি বা আদর্শ, যার অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার । স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার বৃদ্ধির ফলে দেশীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে, স্বদেশি মৃতপ্রায় শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটবে ।

*****

Related Items

আব্দুল গফফর খান (Abdul Ghaffar Khan)

খান আব্দুল গফফর খানের নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আইন অমান্য আন্দোল ব্যাপক আকার ধারণ করে । তিনি মহাত্মা গান্ধির অনুসৃত আদর্শ ও কর্মপন্থার একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন । এজন্য তাঁকে সীমান্ত গান্ধি নামে অভিহিত করা হয় । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাওলাট বিরোধী ...

লবণ সত্যাগ্রহ (Salt Satyagraha)

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে গান্ধিজি গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত ডান্ডি অভিমুখে তাঁর ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু করেন । ডান্ডি থেকে সবরমতী আশ্রম প্রায় দুশো মাইল দূরে অবস্থিত । এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গান্ধিজির ...

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারত (India After World War I)

বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতেও পড়েছিল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত ছিল ব্রিটেনের শক্তির প্রধান উৎস । যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ ভারতকেও একটি যুদ্ধরত দেশ বলে ঘোষণা করেছিল, যাতে যুদ্ধে ভারতীয় লোকবল ও সম্পদ ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায় । ভারতীয়দের মতামত না ...

স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের ফল

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শীঘ্রই প্রতিবাদের পর্যায় অতিক্রম করে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয় । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই জুলাই খুলনার বাগেরহাটে এক বিশাল জনসভায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘বয়কট প্রস্তাব’ নেওয়া হয় ...

স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শীঘ্রই প্রতিবাদের পর্যায় অতিক্রম করে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয় । এই গণআন্দোলনের প্রথম ও মুখ্য কর্মসূচি ছিল ‘বয়কট’ । কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার ...