বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা ও রিজলীর প্রস্তাব (The Scheme of Partitioning Bengal and the Proposal by H. H. Risely) :
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ভারতের গভর্নর নিযুক্ত হয়ে আসার পর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পীঠস্থান বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হন । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই তিনি এক আদেশ বলে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন । লর্ড কার্জনের আমলে এই সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলেও তিনি এই নীতির উদ্ভাবক ছিলেন না । তখন বাংলা বলতে বোঝাত অখন্ড বঙ্গদেশ, বিহার, ওড়িশা ও ছোটোনাগপুর অঞ্চল । ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল গোয়ালপাড়া, কাছাড় এবং শ্রীহট্টকে নিয়ে আসাম নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠিত হয় । ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন । প্রবল বিরোধিতার জন্য তাঁর সে প্রস্তাব বাতিল হয় । তাঁর উত্তরসুরি হেনরি কটনও এটিকে অবাস্তব ও অসংগত বলে মন্তব্য করেন । ফলে প্রস্তাবটি তখনকার মতো বাতিল হয় । ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ. এইচ. রিজলী উইলিয়াম ওয়ার্ডের প্রস্তাবকে আরও সম্প্রসারিত করে বঙ্গভঙ্গের এক নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন । এতে বলা হয় চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে । উড়িয়া ভাষি অঞ্চলকে বাংলার অবশিষ্টাংশের সঙ্গে যুক্ত করা হবে এবং ছোটনাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হবে । লর্ড কার্জন রিজলীর এই প্রস্তাবকে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে গ্রহণ করেন যা বাংলার মানুষের পক্ষে আরও মারাত্মক হয়েছিল । পরিবর্তিত এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ, মালদহ, পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসামকে একত্রিত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে যার রাজধানী হবে ঢাকা । বাংলার অবশিষ্টাংশ, বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠিত হবে 'বঙ্গদেশ' যার রাজধানী হবে কলকাতা । বাংলা তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ছিল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ, কারণ ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যই মূলত বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করা হয়েছিল । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গ-ভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ।
বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য (The Objectives of the Scheme of Partitioning Bengal) :
(ক) বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের সমর্থনে ব্রিটিশ সরকারের যুক্তি ছিল এই যে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে গঠিত অখন্ড বাংলার বিশাল অঞ্চল শাসন করা একজন গভর্নরের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন । তাই প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এবং পিছিয়ে পড়া মুসলিম ও উড়িয়া ভাষীদের উন্নয়নের প্রয়োজনে বঙ্গবিভাজন অপরিহার্য ।
(খ) উনিশ শতকে বাংলা চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও রাজনৈতিক কাজকর্মের প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় ব্রিটিশ স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল । এই আন্দোলনের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে লর্ড কার্জন ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন । বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দূর্বল করে দেওয়াই ছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ।
(গ) বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যাকে পশ্চিমবাংলার জাতীয়তাবাদী চেতনাযুক্ত হিন্দু বাঙালিদের ওড়িয়া ও বিহারিদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার চাপে নতজানু করা এবং পূর্ব বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়কে নতুন প্রদেশ দান করে অনুগত রাখা ছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য । অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের মাধমে অবিভক্ত বাংলাকে ভাগ করে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের আর এক অন্যতম উদ্দেশ্য ।
(ঘ) তৎকালীন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, সচেতনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বাঙালিরা ছিল অগ্রগণ্য, এছাড়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বও তখন ছিল বাঙালিদের হাতে । তাই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাঙালিকে দুর্বল করে জাতীয় কংগ্রেস তথা ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করাই ছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য ।
*****
- 4398 views