কংগ্রেসের সুরাট বিভাজন (The Surat Split of National Congress in 1907) :
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী মতাদর্শের উৎপত্তি ঘটায় । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সুরাটে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসলে নরমপন্থী ও চরমপন্থী এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মত বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছায় । নরমপন্থীগণ স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেও বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও জাতীয় শিক্ষা সম্বন্ধে চরমপন্থীদের প্রস্তাবিত মনোভাব সমর্থন করেন নি । মধ্যপন্থীরা তখনও এই ধারণা পোষণ করতেন যে, ভারতবর্ষের সংহতি ও প্রগতি অক্ষুন্ন রাখার জন্য ব্রিটিশ শাসনের প্রয়োজন আছে । তাই তাঁরা স্বরাজ্যের দাবি সমর্থন করলেও ভারতীয়দের স্বার্থে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন । অন্যদিকে চরমপন্থীরা চেয়েছিলেন সর্বপ্রকার ব্রিটিশ কর্তৃত্বমুক্ত পূর্ণ স্বরাজ । এইসব কারণে উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয় । চরমপন্থী সদস্যগণ কংগ্রেসের এই সুরাট অধিবেশনে লালা লাজপত রায়কে সভাপতি নিযুক্ত করতে চাইলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও গোপালকৃষ্ণ গোখলের বিরোধিতায় তাঁদের দাবি খারিজ হয়ে যায় । শেষ পর্যন্ত রাসবিহারী ঘোষ সুরাট অধিবেশনের সভাপতি নিযুক্ত হন । চরমপন্থীগণ তাঁদের স্বরাজ, স্বদেশি ও বয়কটের প্রস্তাবকে জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ ও কর্মসুচির অঙ্গীভূত করতে ব্যর্থ হন । এ নিয়ে সভায় তুমুল বাদানুবাদ, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় । এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায় প্রমুখ চরমপন্থী নেতারা তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেসের মধ্যেই একটি নতুন দল গড়ে তোলেন । এই ভাবে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙ্গে চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায় । তাই সুরাট অধিবেশনকে 'সুরাট ভাঙ্গন' (Surat split) বলা হয় ।
সুরাট অধিবেশনের তাৎপর্য (Importance of Surat Session) :
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ।
(১) জাতীয় কংগ্রেসের বিভাজনের ফলে জাতীয় আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে । ব্রিটিশ সরকার এরপর নরমপন্থীদের মদত দিয়ে চরমপন্থীদের থেকে দুরে রাখার কৌশল গ্রহণ করে যাতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারে ।
(২) এই বিভাজনের ফলে নরমপন্থীদের প্রাধান্য হ্রাস পায় এবং চরমপন্থীদের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সংগঠিত হয় ।
(৩) সুরাট বিভাজনের ফলে নরমপন্থী নেতৃত্ব কংগ্রেসে তরুণ সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন ।
(৪) চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ এক সুনির্দিষ্ট ভাবধারায় পরিণত হয় । এর একটি হল নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বা স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন, অন্যটি হল সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলন ।
******
- 12043 views