স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের ফল (Importance and Results of Swadeshi and Boycott Movement) :
(১) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শীঘ্রই প্রতিবাদের পর্যায় অতিক্রম করে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয় । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুলাই খুলনার বাগেরহাটে এক বিশাল জনসভায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘বয়কট প্রস্তাব’ নেওয়া হয় । 'বয়কট' প্রস্তাব বাংলা থেকে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে । ব্রিটিশ পণ্যসম্ভার, বিশেষ করে ম্যাঞ্চেস্টারের সুতিবস্ত্র বর্জন করার আহ্বান ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে । বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বদেশিপণ্য ব্যবহারের শপথ নেওয়া হয় । ছাত্ররা বিলাতি লবণ ও চিনি খরিদ করে তা নষ্ট করতে শুরু করে, শহরে এবং গ্রামে গঞ্জে প্রকাশ্যে বিদেশি পণ্য পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং স্বদেশি পণ্য ক্রয়ের সমারোহ শুরু হয় । শহরের বড়ো বড়ো দোকানে ছাত্রদের পিকেটিং শুরু হয় এবং ক্রেতাদের বিলাতি পণ্যসম্ভার খরিদ না করার জন্য অনুরোধ করা হয় । এর ফলে বিলাতি পণ্যের চাহিদা বিশেষভাবে কমে যায় । ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের এক সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বয়কটের প্রভাবে এক বছরের মধ্যে বিলাতি পণ্যসম্ভার বিশেষ করে ম্যাঞ্চেস্টারের সূতিবস্ত্র, বিলাতি লবণ, চিনি, কাঁচের চুড়ি, বিদেশি জুতা ও সিগারেট, বিলাতি সাবান ইত্যাদির আমদানি অভাবনীয়ভাবে কমে গিয়েছিল ।
(২) স্বদেশি আন্দোলন সারা বাংলায় দ্রুত প্রসার লাভ করে । গ্রামগঞ্জে মিটিং, মিছিল, পিকেটিং ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিলাতি দ্রব্যবর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা হয় । ক্রমশ রাজনীতির সীমাবদ্ধ গন্ডি ছাড়িয়ে শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা শিল্পের জগতেও স্বদেশি আন্দোলন সম্প্রসারিত হয় । বয়কট বা বর্জন নীতি সব স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করেছিল । বিলাতি পণ্যসম্ভারের বয়কট বা বর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট শুরু হয় । ধোপা, নাপিত, মুচি প্রভৃতি শ্রেণির সমাজসেবীরা ইংরেজদের সবরকম পরিসেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকে ।
(৩) স্বদেশি আন্দোলনের ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন স্থানে কুটির শিল্প এবং দেশীয় পরিচালনায় বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে । স্বদেশি তাঁত বস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি ও চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন স্থানে কলকারখানা গড়ে ওঠে । বাংলায় ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করেন । ডঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন । মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন । স্বদেশি যুগে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল স্যার জামসেদজি টাটা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামসেদপুরের লৌহ ইস্পাত কারখানা । এই সঙ্গে স্বদেশি ব্যাংক, জীবনবিমা প্রভৃতির ক্ষেত্রেও বেশ উৎসাহ দেখা যায় ।
(৪) স্বদেশি আন্দোলনের যুগে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ২৪টি মাধ্যমিক ও ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । এমনকি জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলার বাইরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ।
স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের ফলশ্রুতি ছিল :
(১) দেশীয় শিল্পোদ্যোগের বিকাশ,
(২) ছাত্র-যুব-নারী সমাজের জাগরণ,
(৩) জাতীয় শিক্ষার বিস্তার,
(৪) স্বদেশি সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ,
(৫) জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতির বিস্তার,
(৬) কংগ্রেসে চরমপন্থী মতবাদের উত্থান
(৭) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিভাজন,
(৮) কলকাতা থেকে দিল্লীতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তর ।
*****
- 2856 views