জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগ (The Early Phase of National Congress) :
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক বিশেষ স্তরে জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয় । উনবিংশ শতাব্দী ছিল 'সভাসমিতির যুগ' । ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ নিয়ে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সঙ্গে এ দেশের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয় ।
কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন (The First Session of the Indian National Congress) :
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে ডিসেম্বর বোম্বাই -এ গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসে । ২৮ থেকে ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনদিন ব্যাপী এই অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি তাঁর সভাপতির ভাষণে কংগ্রেসের চারটি প্রধান উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন—
(১) দেশের কল্যাণ সাধনে ব্রতী এরূপ ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করা ।
(২) জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে অন্তরায় এমন সব জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য ও প্রাদেশিক কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথ প্রশস্ত করা ।
(৩) জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যাগুলি সম্পর্কে ভারতের শিক্ষিত সমাজের সুচিন্তিত মতামত লিপিবদ্ধ করা ।
(৪) তাঁদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সেই সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করা এবং পরবর্তী এক বছরে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকলাপ জনস্বার্থে কোন পথে পরিচালিত হওয়া উচিত তা স্থির করা । এই অধিবেশনেই ভারতীয়দের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা ও প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মোট ৭২ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেছিল । তাঁদের বক্তৃতায় ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্যের কথা ঘোষিত হয় ।
কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন (The Second Session of the Indian National Congress) :
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে । দাদাভাই নৌরজি এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন । হিউমের অনুরোধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সদলবলে কংগ্রেসে যোগ দিলে দলটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং দলে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয় । দ্বিতীয় অধিবেশনে আরও কতকগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ভারতীয় জনগণের সীমাহীন দারিদ্রের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় । দ্বিতীয় অধিবেশনে নির্বাচিত সদস্যদের যোগদানে কংগ্রেস রীতিমতো প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থার মর্যাদা পায় ।
কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশন (The Third Session of the Indian National Congress) :
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশন বসে । এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন বদরুদ্দিন তায়েবজী । প্রচুর উত্সাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ৬০৭ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি এই অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন । কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল ও সেই সঙ্গে এক শ্রেণির জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বাড়ছিল । এঁরা অধিকাংশই ছিলেন বাংলা থেকে আগত প্রতিনিধি । বাংলা থেকে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, বিপিনচন্দ্র পাল দাবি জানান কংগ্রেসকে দু-চারজন নেতার কুক্ষিগত করে রাখা চলবে না ও দলের গণতন্ত্রীকরণের জন্য তাঁরা নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন । তাঁদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত একটি 'বিষয় নির্বাচনী কমিটি' গঠিত হয় এবং কমিটির উপর কংগ্রেসের বাকি অধিবেশনের আলোচ্য সূচি স্থির করার দায়িত্ব অর্পিত হয় । কলকাতায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল সর্বভারতীয় বিষয়গুলি আলোচনায় স্থান পাবে । তার বাইরে গিয়ে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি আসামের চা বাগিচার শ্রমিকদের ওপর মালিকদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিষয়টি অধিবেশনে আলোচনার দাবি জানান ।
কংগ্রেসের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব (The The British Attitude towards Indian National Congress) :
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকলাপ এবং নেতৃবৃন্দের মনোভাব সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার আগাগোড়াই সজাগ ছিলেন । কলকাতায় আহুত দ্বিতীয় অধিবেশনে বাঙালি নেতৃবৃন্দের যোগদানের পর থেকেই তাঁরা এঁদের মনোভাব ও কথাবার্তার ওপর তীক্ষ্ম নজর রেখেছিলেন । ফলে বোম্বাই অধিবেশনে যে সরকারি পর্যবেক্ষক দল উপস্থিত ছিলেন কলকাতায় দ্বিতীয় অধিবেশন থেকেই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় । মাদ্রাজ অধিবেশনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডাফরিন ঘোষণা করেন কংগ্রেস তার প্রতিশ্রুত পথে যাচ্ছে না । হিউমের কথামত কংগ্রেস ইংল্যান্ডের বিরোধী দলের মতো ভূমিকা পালনে ব্যর্থ । বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ভাইসরয় আরও ঘোষণা করেন যে, কংগ্রেস ভারতীয় জনসাধারণের অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দ্রষ্টব্য এক ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধি মাত্র এবং তাঁরা না জেনেশুনে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছেন । 'কংগ্রেস হল বাবু শ্রেণির একটি সংগঠন মাত্র'— একথা বলেও তিনি কংগ্রেসের কৃতিত্বকে হেয় করতে চেয়েছিলেন । অতঃপর কংগ্রেস সম্পর্কে ব্রিটিশের অপছন্দের মনোভাব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে । এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত চতুর্থ অধিবেশন থেকেই ব্রিটিশের কংগ্রেস বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সরকারি বিরোধিতায় উদ্যোক্তারা অধিবেশনের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার মহারাজা লোথাল ক্যাসেল নামক প্রাসাদটি কিনে নেন এবং সেটি কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য ছেড়ে দেন ।
সাম্প্রদায়িক উস্কানি : কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও প্রভাব প্রতিপত্তিতে শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অগ্রগতি রোধ করার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন । কংগ্রেসের নেতৃত্বে যাতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হতে না পারে তার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে শুরু করেন । তাঁদের উস্কানিতেই কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলে জনৈক মুসলমান সদস্য আনুপাতিক হারে মুসলমান সদস্য গ্রহণের সংস্থান রাখার প্রস্তাব করেন । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বেশির ভাগ মুসলমান সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন ।
*****
- 6369 views