বিপ্লবী আন্দোলন (Revolutionary movements)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/24/2012 - 08:33

বিপ্লবী আন্দোলন (Revolutionary movements) :

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বাঘাযতীনের মৃত্যুর পর বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কঠোর নিরাপত্তা এবং দমনমূলক আইন প্রয়োগের ফলে প্রায় এক দশক বাংলায় বিপ্লবী কার্যকলাপ স্তিমিত ছিল । ভারত রক্ষা আইনে নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ব্রিটিশ সরকার বহু ব্যক্তিকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল । সন্ত্রাসবাদী দল ও নেতৃবর্গের গোপন আস্তানায় হানা দিয়ে বহু অস্ত্রশস্ত্র সহ বহু ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এক রাজকীয় আদেশ বলে সকল রাজনৈতিক বন্দির অপরাধ মকুব করে সকলকে মুক্তি দেয় ।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে দেশবাসী বিশেষত তরুণ ও ছাত্র সম্প্প্রদায় গভীর প্রত্যাশায় আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে ছিল । অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ৫ই ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় একদল হিংসাত্মক জনতা এক পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন লাগিয়ে ২২জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারে । এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে গান্ধিজি আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিলে দেশবাসী গভীরভাবে হতাশ হয়ে পড়ে । ফলে দেশব্যাপী বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা শুরু হয় । বাংলার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর প্রভৃতি গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থাগুলি পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে । যুগান্তর দল কয়েকটি ডাকাতি করে বহু অর্থ লুন্ঠন করে এবং বাঘাযতীন হত্যার নায়ক কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে ক্রমাগত হত্যার চেষ্টা করে ।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ কলকাতায় একটি এবং দক্ষিণেশ্বরে একটি বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করে । বিপ্লবীগণ এ সময়ে পুলিশ এবং অপরাধ অনুসন্ধান বিভাগের বহু কর্মীকে হত্যা করেছিলেন । ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিকেলের ছাত্র বিনয় বসু ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে আগস্ট ঢাকায় বাংলার পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে হত্যা করেন । গ্রেপ্তারি এড়াবার জন্য বিনয় বসু ছদ্মবেশে কলকাতায় পালিয়ে আসেন ও এখানে এসে যুগান্তর দলের দুই বিপ্লবী বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে মিলিত হন ।

(ক) ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত ছদ্মবেশে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং -এ প্রবেশ করেন । তাঁরা দোতালায় উঠে গিয়ে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে হত্যা করেন ও আর একজন ইংরেজ কর্মচারী আহত হন ।

(খ) এরপর তিন জন একটি ছোট্ট ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করে বন্দেমাতারম ধ্বনি দিতে দিতে পূর্বদিকের বারান্দায় ছুটে যান । এই সময় রাইটার্স বিল্ডিং -এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের খন্ড যুদ্ধ শুরু হয় ।

(গ) ইতিমধ্যে নিকটবর্তী লালবাজার থেকে বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে পুলিশ কমিশনার চালর্স টেগার্ট তাঁদের ঘিরে ফেলেন । এরপর রাইটার্স বিল্ডিংস -এর অলিন্দে তিন তরুণের সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর গুলির লড়াই শুরু হয়, যা ইতিহাসে ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে খ্যাত ।

(ঘ) শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের সমস্ত গুলি ফুরিয়ে গেলে পালানো অসম্ভব বিবেচনা করে তিন জনই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন । বাদল গুপ্তের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় । গুরুতর আহত অবস্থায় বিনয় বসু ও দিনেশ গুপ্ত ধরা পড়েন । কয়েকদিন পর হাসপাতালে বিনয় বসু নিজের ক্ষতস্থান বিষাক্ত করে মৃত্যু বরণ করেন । দীনেশ গুপ্ত আরোগ্য লাভ করলেও পরে মৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত হন ।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার বহু ইংরেজ এবং উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মচারী বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন । ওই সময় মেদিনীপুর ছিল বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের অন্যতম কেন্দ্র এবং বেঙ্গল ভলেণ্টিয়ার্স সংক্ষেপে B.V. দলের পীঠস্থান । এই দলেরই সদস্য বিমল দাশগুপ্ত মেদিনীপুরের জেলাশাসক অত্যাচারী পেডিকে হত্যা করেন । বিপ্লবী কানাই ভট্টাচার্য বিচারক গার্লিককে তাঁর এজলাসে হত্যা করেন । ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে হিজলি জেলে বিপ্লবী বন্দিদের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে দুজন বিপ্লবীর মৃত্যু হয় । এ জন্য বিমল দাশগুপ্ত ইউরোপীয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভিলিয়ার্সকে হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন । এই বৎসরই দুই অল্প বয়স্কা বালিকা শান্তি ও সুনীতি কুমিল্লার জেলাশাসক মিঃ স্টিভেনস এবং এস. পি. মিঃ এলিসকে হত্যা করেন । ওই বৎসরই প্রভাংশু পাল ও প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে গুলি করে হত্যা করেন । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মৃগেন দত্ত ও অনাথবন্ধু পাঁজা পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্জকে গুলি করে হত্যা করেন । উভয়েই বার্জ -এর দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান । এই সকল ঘটনায় একদিকে যেমন সারা বাংলায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীবৃন্দ শঙ্কিত হন ।

এই সময়কার চাঞ্চল্যকর ঘটনা হল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন । এই দুঃসাহসিক অভিযানের নায়ক ছিলেন সূর্যসেন । তিনি মাস্টারদা নামেও পরিচিত ছিলেন । সূর্যসেন একটি জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন । তিনি অসহযোগ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন । অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, জীবন ঘোষাল, অম্বিকা চক্রবর্তী ও গণেশ ঘোষ ছিলেন তাঁর কতিপয় বিশ্বস্ত ও দক্ষ সহচর । এর সদস্যগণ অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আসাম-বেঙ্গল রেলপথের কার্যালয় থেকে ৭৭,০০০ টাকা লুঠ করেছিল । এরপর সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী সংস্থার সদস্যগণ অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা চালাতে থাকে । মাস্টারদা সূর্যসেনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রামের সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে তিনি ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ সেই অস্ত্র দিয়ে বাংলায় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাবেন এবং তার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করবেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল মধ্যরাত্রে তাঁরা চট্টগ্রামের পুলিশ অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেন । এই সময় সূর্যসেনের অন্যতম সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহ, উপেন ভট্টাচার্য, জীবন ঘোষাল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত প্রমুখ ।

অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী বিপ্লবীদের সন্ধানে তৎপর হয় । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৬৪ জন ব্রিটিশ সৈন্য ও কয়েকজন বিপ্লবী প্রাণ হারান । এটি 'জালালবাদের মুক্তিযুদ্ধ' নামে পরিচিত । শাসকশ্রেণির কড়া নজর ও অত্যাচার সত্ত্বেও সূর্যসেনের বিপ্লবী দল তাঁদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছিলেন । সূর্যসেন সহ কিছু সংখ্যক বিপ্লবী জালালবাদ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন । এমনই একটি ছয় জনের সশস্ত্র বিপ্লবী দল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মে কর্ণফুলী নদীর তীরে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায় । এটি 'কর্ণফুলীর যুদ্ধ' নামে পরিচিত । এই যুদ্ধে চারজন বিপ্লবী মারা যান এবং দু'জন আত্মসমর্পণ করেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জুন ধলঘাটের পাতিয়া গ্রামে সূর্যসেন সহ তাঁর ছোট্ট বাহিনীকে পুলিশ ঘিরে ফেললে সংঘর্ষে দুজন বিপ্লবী নিহত হন । এই সময় সূর্যসেন এবং কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পালিয়ে যান । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলির একটি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নেতৃত্ব দেন । এই সময় একজন সাহেবকে হত্যা ও ১৩ জনকে গুরুতর আহত করে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নিজেই পুলিশের গুলিতে আহত হয় ও পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় মেধাবী ছাত্রী বিণা দাস বাংলার গভর্নর স্যার আন্ডারসন জ্যাকসনের প্রাণনাশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ও ধরা পড়েন । বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সঙ্গে জড়িত বিপ্লবীদের বিচার সমাপ্ত হয় ও বিপ্লবীদের মধ্যে চোদ্দজন আন্দামানে নির্বাসিত হন । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন চট্টগ্রামের গেরিলা গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশের গোর্খা বাহিনীর বিরুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে গ্রেপ্তার হন । ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি চট্টগ্রামের জেলেই বিচারে তাঁর ফাঁসি হয় । সূর্যসেনের বিপ্লবী জীবন ও দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করেছিল ।

*****

Related Items

নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? এই সময়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক বাংলা নাটকের নাম কর । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

প্রশ্ন:- নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? এই সময়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক বাংলা নাটকের নাম কর । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

বাংলায় সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যাবলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  বাংলায় সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যাবলি উল্লেখ কর ।

প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? জ্যোতিবা ফুলে কেন স্মরণীয় ? উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি সমাজে কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? জ্যোতিবা ফুলে কেন স্মরণীয় ? উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি সমাজে কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডঃ আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ।

উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ? ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ? ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন:- উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ? ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ? ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল—

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস উডের প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল ?

প্রশ্ন:- ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস উডের প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল ?

শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় । এই কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল—