Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 10:53

বাঘাযতীন (Jatindranath Mukhopadhyay known as Bagha Jatin) :

দেশে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য বিপ্লবীগণ বিদেশ থেকে গোপনে নানা উপায়ে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলেন । বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে 'আত্মোন্নতি সমিতির' প্রতিষ্ঠাতা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির প্রেরণায় এবং যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘ যতীন) নেতৃত্বে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে আগস্ট কলকাতার ধর্মতলায় 'রডা এন্ড কোম্পানি' -এর দোকান থেকে বিপ্লবীরা ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬০০ রাউন্ড কার্তুজ লুঠ করেন । এরপর বাঘাযতীন ওড়িশার বালেশ্বরে এসে 'ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম' গঠন করে আত্মগোপন করেন । এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী দেশ জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন । এই প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসাবে ইউরোপের একজন প্রবাসী ভারতীয় জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারতে বিপ্লব অভ্যুত্থানের জন্য জার্মানি থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যের আশ্বাস পান । এই উদ্দেশ্যে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সি.আর.মার্টিন নাম নিয়ে বাটাভিয়ার যান ও সেখানে জার্মান দূতাবাস মারফত জার্মানির সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরলেন যে জার্মান অস্ত্র বোঝাই তিনখানি জাহাজ ভারতে আসবে । প্রতিশ্রুতি মত জার্মান কনসাল ম্যাভেরিক, অ্যানি লার্সেনহেনরি-এস নামে তিনটি অস্ত্রবোঝাই জাহাজ একটি হাতিয়ায়, একটি সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে এবং একটি ওড়িশার বালেশ্বর উপকূলের উদ্দেশ্যে পাঠান । কিন্তু ইংরেজ সরকার এই অস্ত্র আমদানির কথা জানতে পেরে 'মাভেরিক' সহ অস্ত্রবোঝাই তিনখানি জাহাজই আটক করেন । ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ 'ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়ামে' তল্লাশি চালায় । অন্যদিকে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে বলেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হন ও বুড়িবালামের তীরে অপেক্ষারত বাঘাযতীনের বাহিনীকে ঘিরে ফেলে । বালেশ্বর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে কাপ্তিপোদা নামক স্থানে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ই সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয় । স্থানটি বুড়ীবালামের তীরে বলে এটি বুড়ীবালামের যুদ্ধ নামে খ্যাত । এই অসম যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথের চার সঙ্গী জ্যাতিষ পাল, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন দাশগুপ্ত বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়েছিলেন । কিন্তু ২০ মিনিটের গুলিযুদ্ধে বাঘাযতীন গুরুতর আহত হন ও ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ই সেপ্টেম্বর বাঘাযতীন বালেশ্বর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন । ঘটনা স্থলেই চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী মারা যান । বিচারে জ্যোতিষ পালের ১৪ বছর (যাবজ্জীবন) সশ্রম কারাদন্ড হয় এবং আহত মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন দাশগুপ্তের ফাঁসি হয় । বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে বুড়িবালামের যুদ্ধ এক স্মরণীয় ঘটনা । বাঘাযতীনের মৃত্যুর সঙ্গে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ।

*****

 

Related Items

প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ (Resistance and Rebellion) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করতে শুরু করে । এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে ভারতের বি

উনিশ শতকের বাংলার 'নবজাগরণ' ধারণার ব্যবহার বিষয়ক বিতর্ক

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় কেউ কেউ তাকে 'নবজাগরণ' বলে অভিহিত করেছেন । প্রকৃত অর্থে এই অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলা যায় কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও পন্ডিতমহলে বিতর্কের শেষ নেই । ঐতিহাসিক যদুনাথ

বাংলার নবজাগরণ -এর চরিত্র ও পর্যালোচনা

ঊনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় । এই অগ্রগতি সাধারণভাবে 'ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ' নামে পরিচিত । রেনেসাঁস (Renaissance) কথাটির আক্

লালন ফকির

ঊনিশ শতকে বাংলায় সর্বধর্মসমন্বয়ের ক্ষেত্রে যাঁরা গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছিলেন লালন ফকির বা লালন সাঁই হলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম আধ্যাত্মিক বাউলসাধক । তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও বাংলাদেশের বাউলগানের শ্রেষ্ঠতম রচয়িতা ছিলেন । তিনি সাধারণ মানুষের কাছে লালন ফকির ...

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ : নব্য বেদান্ত — বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

ভারতের প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যাকর্তা ছিলেন আদি জগৎগুরু 'শঙ্করাচার্য' । 'বেদান্ত' শব্দের অর্থ হল বেদের অন্ত বা শেষ, আর বেদের অন্ত হল উপনিষদসমূহ । ব্রহ্ম হল বেদান্ত দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয় । উপনিষদ, ভগবতগীতা এবং ব্রহ্ম সূত্র ও তার ভাষ্য বি