নতুন সামাজিক ইতিহাস (New Social History)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 09/21/2020 - 10:58

নতুন সামাজিক ইতিহাস : ইতিহাসের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সামাজিক ইতিহাস । আগে সামাজিক ইতিহাস শুধু রাজা-মহারাজা, অভিজাতবর্ণ ও উচ্চবর্ণের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু বর্তমানে সমাজের সাধারণ, নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক মানুষের আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । ফলে সামাজিক ইতিহাস 'নতুন সামাজিক ইতিহাস' রূপে পরিচিত হয়েছে । ১৯৬০-৭০ -এর দশকে নতুন সামাজিক ইতিহাসের আলোচনার সূত্রপাত ঘটে । এই সময় থেকে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেসব মানুষের ইতিহাস চর্চা শুরু হয় । নতুন সামাজিক ইতিহাসের আলোচনায় ওপর থেকে নীচের দিকে দেখার পরিবর্তে নীচে থেকে ওপরের দিকে দেখার চেষ্টা করা হয় । সমাজের মুষ্টিমেয় উচ্চবর্গের মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাধারণ ও নিম্নবর্গের মানুষের ভূমিকার ভিত্তিতে সমাজকে দেখার চেষ্টা করা হয় । নতুন সামাজিক ইতিহাসে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্গ অপেক্ষা বৃহত্তর সাধারণ, নিম্নবর্গের ও প্রান্তিক মানুষকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় । সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবদান নতুন সামাজিক ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয় । ঐতিহাসিক ই.এইচ. কারের মতে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কোনো একমাত্রিক সর্বসম্মত পদ্ধতি হয় না, ইতিহাসের কেন্দ্রীয় বিষয় হল মানুষ এবং তার কাজকর্ম । মানুষের ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত হয় তার ইচ্ছা, আবেগ, সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়গুলি । এই সামগ্রিকতার কোনো নির্দিষ্ট রূপ হয় না । যে-কোনো সমাজে বিত্তবান মানুষও যেমন বাস করে, তেমনিই অত্যন্ত গরিব মানুষও বাস করে, যাদের প্রতিদিনের খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত নয় । উচ্চশিক্ষিত মানুষের সহাবস্থান ঘটে নিরক্ষর মানুষের সঙ্গে । সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অর্থনীতির একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে । আজকের ইতিহাসচর্চায় মানুষের আর্থসামাজিক জীবন বিশ্লেষণ করার প্রবণতা বেড়েছে । বিংশ শতকে নতুন সামাজিক ইতিহাস রচনায় সমাজের নিম্নবর্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ, দরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আলোচনা প্রাধান্য পায় । এই সময় থেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নতুন সামাজিক ইতিহাসকে জনপ্রিয় করে তোলেন ।

ইতিহাস লেখকের কাজ কী হওয়া উচিত তা নতুন করে দেখার সূত্রপাত হয় লুসিয়েন ফেবর এবং মার্ক ব্লখ -এর হাত ধরে । ফ্রান্সে এঁরা 'অ্যানাল' পত্রিকার মধ্য দিয়ে সমাজে মানুষের বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ দিকগুলিকে অনুধাবনের প্রচেষ্টা শুরু করেন । অ্যানাল গোষ্ঠীভুক্ত ফরাসি ঐতিহাসিকদের হাত ধরে মানুষের সামগ্রিক ইতিহাসচর্চা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে । অ্যানাল গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিনিধিরা হলেন লুসিয়েন ফেবর, মার্ক ব্লখ, ফার্নান্দ ব্রদেল, রয় লাদুরি প্রমূখ । তাঁদের ইতিহাসচর্চায় তৃণমূল স্তরের মানুষের পরিসংখ্যান, দিনগত জীবনযাপনের বিশ্লেষণ, জনতার মানসিকতা, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতির আলোচনা স্থান পায় । ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ই. পি. থমসন ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে 'History from Below' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন । এই সময় থেকেই নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার যাত্রা শুরু হয় । নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার মূল ধারণা হল— সাধারণ জনগণই ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে । এই ধারণা অনুসারে সামাজিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু হল সবধরনের মানুষের কার্যকলাপ, আইনজগৎ, গ্রামীণ-নাগরিক সমাজের মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা ইত্যাদি । প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত তত্ত্ব, শস্যের ফলনের হিসাব, জমির আকৃতি, মহামারি, পোশাক, উৎপাদন ব্যবস্থা, পণ্য এবং সম্পদের বিভাজনগত তথ্যের বিন্যাস প্রভৃতি বিষয় ইতিহাসচর্চায় গৃহীত হয় । রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শাহিদ আমিন, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, সুমিত সরকার প্রমূখ সাবঅল্টার্ন (নিম্নবর্গীয়) ঐতিহাসিক জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের ইতিহাসচর্চা করে নিম্নবর্গের ইতিহাসকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন । ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদে সাধারণের অংশগ্রহণ এবং আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার প্রতিফলনে আধুনিক ইতিহাসচর্চা বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠ ।

****

Comments

Related Items

ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো ।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রকাশ করা হয় । ভারতীয় সংবিধানের চারটি উল্লেখযোগ্য প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—

মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

প্রশ্ন:-  মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:- ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

প্রশ্ন:-  ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?