আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের গুরুত্ব :-
(৪) সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র (বঙ্গদর্শন ও সোমপ্রকাশ) : আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সমসাময়িক বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক হিসাবে সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয় । ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হিকি'জ 'বেঙ্গল গেজেট' -এর মাধ্যমে বাংলায় সংবাদপত্রের সূচনা হয় । এটি ছিল ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা । বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িক পত্র 'দিগদর্শন' মাসিক হিসেবে ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে জোশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় বাংলার শ্রীরামপুরের 'শ্রীরামপুর মিশন প্রেস' থেকে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন কর্তৃক প্রকাশিত হয় । ওই বছরেই মে মাসে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'সমাচার দর্পণ' । এরপর একের পর এক বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে । আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'বঙ্গদর্শন' ও সোমপ্রকাশ পত্রিকা ।
(ক) বঙ্গদর্শন : ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় মাসিক পত্রিকা 'বঙ্গদর্শন" প্রথম প্রকাশিত হয় । বঙ্গদর্শনে সাহিত্য, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, সংগীত, বিজ্ঞান, প্রাচীন সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, কৃষিতত্ত্ব, গ্রন্থালোচনা ও বাঙালির জীবনচর্চা প্রকাশ পেত । বঙ্গদর্শনকে কেন্দ্র করে একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল । এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন চন্দ্রনাথ বসু, রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রামদাস সেন, চন্দ্রশেখর মুখার্জী, হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ । বঙ্কিমচন্দ্রের বহু রচনা প্রথমে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়েছিল । বঙ্গদর্শন পত্রিকায় অনেক সময়ই লেখকের নাম থাকত না, থাকত সংক্ষিপ্ত নাম — স. চ, চ. ব ইত্যাদি । বঙ্গদর্শন পত্রিকার ৪৮ টি সংখ্যা বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদন করেন । তারপর এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর সম্পাদনায় এটি পুনঃপ্রকাশিত হয় । শেষে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় এই পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পর বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশ বন্ধ করে দেন । ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বঙ্গদর্শন বাঙালির মন ও মননকে স্বাদেশিক চেতনায় উদবুদ্ধ করে তুলেছিল । সমকালীন বাঙালি জাতির সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠত করেছিল বঙ্গদর্শন । এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে আধুনিক নব্য শিক্ষিত বাঙালির সঙ্গে আপামর বাঙালি সমাজের সংস্কৃতির মেলবন্ধন গড়ে উঠেছিল ।
সোমপ্রকাশ : সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর সাপ্তাহিক 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় । ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস থেকে দ্বারকানাথ ২৪ পরগনার সোনারপুর স্টেশনের কাছে তাঁর বাড়ি চাংড়িপোতা গ্রামে থেকে এই পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন । সোমপ্রকাশ পত্রিকা আগেকার সাহেবি বাংলা, মৈথিলি বাংলা এবং সংস্কৃত বাংলা প্রভৃতি ভেঙেচুরে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা চালু করে বাংলাভাষার বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে । এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি নানা বিষয় প্রকাশিত হত । কৃষকদের চেতনার জাগরণে, নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে এই পত্রিকায় বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয় । এই পত্রিকায় স্বদেশিকতার প্রচার চালানো হয় । কাবুলে ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করায় ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট -১৮৭৮ -এ এই পত্রিকাকে রাজদ্রোহের অপরাধে মুচলেখা ও অর্থদণ্ড দিতে বলা হয় । সম্পাদক তা দিতে অস্বীকার করলে ব্রিটিশ সরকার এই পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেয় । পরে পুনরায় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস থেকে এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে । ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথের মৃত্যু পর কিছুদিন তাঁর পুত্র উপেন্দ্র কুমার এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন । শেষে এটির মালিকানা বদল হয়ে সহচর (বা নব বিভাকর) সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে মিশে যায় । এই পত্রিকা নিরপেক্ষতা ও প্রতিবাদের প্রতীকরূপে এইসময়ের ইতিহাসের জীবন্ত দলিল ।
******