স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও ।

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 01/10/2022 - 08:34

প্রশ্ন:  স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও ।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন নামে খ্যাতি লাভ করে । এই আন্দোলনের যুগ্ম চরিত্রের একটি স্বদেশি ও অন্যটি বয়কট নামে পরিচিত । ‘স্বদেশি’ও ‘বয়কট’ ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র ।

(১) বয়কট : ‘বয়কট’ কথার অর্থ হল বর্জন । ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখ্য কর্মসূচি ছিল বয়কট । বয়কট অর্থে শুধু মাত্র বিলাতি বস্ত্র বা পণ্যসামগ্রীই নয়, বিলাতি চিন্তাধারা, আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থ্যা, আইন ব্যবস্থা, পৌরসভা, আইনসভা প্রভৃতি সব কিছুই বয়কটের মাধ্যমে বর্জন করার আদর্শ প্রচারিত হয় । প্রথমে বিলাতি পণ্যসম্ভার বিশেষত সুতিবস্ত্র বর্জন করা বয়কট আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল, পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বয়কট করা হয় । এমনকি ইংরেজি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কটও শুরু হয় ।

(২) স্বদেশি : বয়কটের পরিপূরক হিসেবে স্বদেশি চিন্তাধারারও বিকাশ ঘটে । স্বদেশির অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘কেবল স্বদেশি দ্রব্যই নহে, সর্বপ্রকার বিদেশি আদর্শের পরিবর্তে জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষাপদ্ধতি এবং রাজনৈতিক আদর্শ, লক্ষ্য ও পন্থা জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করে’। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে ‘স্বদেশি’ কথার অর্থ ছিল বিলাতি জিনিসপত্র ও চিন্তাধারার বদলে দেশীয় জিনিসপত্র ও চিন্তাধারাকে গ্রহণ করার নীতি বা আদর্শ, যার অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার ।

বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলনের কর্মসূচী :

(১) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শীঘ্রই প্রতিবাদের পর্যায় অতিক্রম করে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয় । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুলাই বাগেরহাটে এক বিশাল জনসভায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘বয়কট প্রস্তাব’ নেওয়া হয় । বয়কট প্রস্তাব বাংলা থেকে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে । বয়কটের প্রভাবে বিলাতি পণ্যসম্ভার বিশেষ করে ম্যাঞ্চেস্টারের সূতিবস্ত্র, বিলাতি লবন, চিনি, কাঁচের চুড়ি, জুতা ও সিগারেটের আমদানি অভাবনীয়ভাবে কমে গিয়েছিল ।

(২) স্বদেশি আন্দোলন বাংলাদেশে প্লাবনের মতো প্রসার লাভ করে । গ্রামগঞ্জে মিটিং, মিছিল, পিকেটিং ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিলাতি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা হয় । ক্রমশ রাজনীতির সীমাবদ্ধ গন্ডি ছাড়িয়ে শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি তথা শিল্পের জগতেও স্বদেশি আন্দোলন সম্প্রসারিত হয় ।

(৩) স্বদেশি আন্দোলনের ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন স্থানে কুটির শিল্প এবং দেশীয় পরিচালনায় বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে । বাংলায় ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করেন । ডঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন । মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন । তবে বিদেশি যুগে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল স্যার জামসেদজি টাটা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামসেদপুরের লৌহ ইস্পাত কারখানা ।

(৪) স্বদেশি আন্দোলনের যুগে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ২৪টি মাধ্যমিক ও ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । এমনকি জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলার বাইরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ।

এক কথায় বলা যায়, স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের ফলশ্রুতি ছিল : 

(i) দেশীয় শিল্পোদ্যোগের বিকাশ,

(ii) ছাত্র-যুব-নারী সমাজের জাগরণ,

(iii) জাতীয় শিক্ষার বিস্তার,

(iv) স্বদেশি সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ,

(v) জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতির বিস্তার,

(vi) কংগ্রেসে চরমপন্থী মতবাদের উত্থান ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিভাজন,

(vii) বঙ্গভঙ্গ এবং

(viii) কলকাতা থেকে দিল্লীতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তর ।

*****

Comments

Related Items

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society)

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society):-

বাঙালিদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা কর