সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ (Millitant Nationalism)

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 21:53

সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ (Millitant Nationalism) :

স্বদেশের তথা মাতৃভূমির গৌরব ও অগৌরবকে কেন্দ্র করে সেই দেশের মানুষ বা জাতির অন্তরে যে উল্লাস, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, অনুভূতি, জাতীয় চেতনা, আত্মমর্যাদা ও আত্মাভিমান সঞ্চারিত হয় তাকেই জাতীয়তাবাদ বলে । জাতীয়তাবাদ যখন সংগ্রামী রূপ ধারণ করে তখন তাকে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ বলে ।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতকের শুরুতে ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল কথা ছিল স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার । দয়া ভিক্ষা করে স্বাধীনতা লাভ করা যায় না । দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও আত্মশক্তির দ্বারাই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় । পরাধীন ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তিনটি ধারায় পরিচালিত হয়, যথা—

(১) আত্মশক্তির আদর্শ বা স্বদেশি আন্দোলন,

(২) নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন বা বয়কট এবং

(৩) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ।

সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ (Causes of the Growth of Millitant Nationalism) :

(ক) অর্থনৈতিক শোষণ (Economical Exploitation) :-  ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের অন্যতম কারণ ছিল । ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের শুল্ক সংক্রান্ত আইন ও ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের কার্পাসবস্ত্র আইনের ফলে ভারতের বস্ত্রশিল্প ও বণিকরা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । তাছাড়া উচ্চহারে ভুমিরাজস্ব ধার্য, শ্রমিকদের স্বল্প বেতন, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় সরকারের দায়িত্বহীনতা ইত্যাদির জন্য ব্রিটিশকেই দায়ী করা হয় । এদেশে আইন কানুন সবই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ছিল । ফলে জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার সীমা ছিল না । ভারতবাসীর ক্রমপুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রতিকারের পথ না পেয়ে পরিশেষে প্রতিবাদের পথ খুঁজে নেয় । সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ তাঁরই পরিণত রূপ ।

(খ) সরকারি দমননীতি (True Nature of British Rule) :- সাম্রাজ্যবাদী শাসক লর্ড লিটন -এর সময় থেকে বিভিন্ন দমন আইন, লর্ড কার্জনের 'মিউনিসিপ্যাল আইন', 'ইউনিভার্সিটি আইন' ইত্যাদি জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ ভারতবাসীদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয় । ক্রমপুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ  কালক্রমে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয় ।

(গ) সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী (Contemporary International Events) : সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী এবং তার প্রতিক্রিয়া ভারতবাসীকে সংগ্রামমুখী করে তুলেছিল । ব্রিটেন ও ইটালির বিরুদ্ধে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদীদের সংগ্রাম ও তার সাফল্য, রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের মতো ছোট দেশের কাছে রাশিয়ার মতো বিশাল দেশের পরাজয় ইত্যাদি আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি থেকে ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অপরাজেয় নয় । এই ধারণা ও আত্মবিশ্বাস ভারতবাসীকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে তোলে ।

(ঘ) নরমপন্থীদের ব্যর্থতা (Failure of the Moderates) : ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদি পর্বে অর্থাৎ ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম কুড়ি বছরে গৃহীত নীতি, কর্মপন্থা, নরমপন্থীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ভারতবাসীর অভাব অভিযোগ পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল । ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের নরমপন্থীদের ব্যর্থতা চরমপন্থী নেতৃবৃন্দকে সংগ্রামমুখী করে তুলেছিল । এই সময়কার জাতীয় আন্দোলন দু-ধারায় পরিচালিত হয়েছিল— একটি চরমপন্থীদের নেতৃত্বে চরমপন্থী আন্দোলন, অন্যটি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন । কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ বা চরমপন্থী মতবাদ ছিল অত্যাধিক ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের অন্তরায় । তাঁরা এজন্য গঙ্গাস্নান, রাখিবন্ধন, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের পরিকল্পনা এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের দেশকে দেশ-মাতৃকারূপে ভাবনার ঘোর বিরোধী হয়ে পড়েন । এঁরা সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করেই দেশমাতৃকার মুক্তি সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন । তাঁদের চিন্তা ধ্যানধারণার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভাবনার লেশমাত্র ছিল না । এ বিষয়ে সোভিয়েত ঐতিহাসিক কোমারভের মতে ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভিত্তি করেই জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন । আনন্দমঠের পরিকল্পনা, বন্দেমাতরম, রাখিবন্ধন কিংবা তিলকের 'শিবাজি ও গণপতি' উৎসব জাতীয় আবেগের অন্য এক নাম । সুতরাং সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের বিকাশে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ভুমিকা থাকলেও ভারতের নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদকে রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট জাতীয়তাবাদ বলে ব্যাখ্যা করা সমীচীন নয় । বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, তিলক, অরবিন্দ প্রমুখ মনীষীবৃন্দ সাম্প্রদায়িকতার বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন । তাঁদের ভাবনায় সবার ঊর্ধ্বে ছিল দেশ, দেশবাসী এবং তাদের স্বাধীনতা ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ।

(ঙ) আদর্শগত কারণ (Neo-Hinduism) :  ভারতবর্ষে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূলে আদর্শগত কারণ অন্যতম । ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের পিছনে যেমন দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল, ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূলে তেমনই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দ এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর পরোক্ষ অবদান ছিল । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠে সন্তান দলের ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের আদর্শ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল । আনন্দমঠে সন্তান দলের উচ্চারিত বন্দেমাতরম মন্ত্র পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জাতীয় মুক্তি মন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছিল । তিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বিক অবক্ষয় ও নীতি হীনতাই ভারতবাসীর পরাধীনতার মূল কারণ । ভারতবাসীকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য । তাই তিনি জাতিকে দিয়েছিলেন দেশকে ভালবাসার, দেশের মুক্তি মন্ত্র 'বন্দেমাতরম' । স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শে পরিণত করেন । তিনি বলতেন "দুর্বলতাই হল দাসত্বের নামান্তর, দুর্বলতাই হল মৃত্যু " । তাই তিনি ভারতীয় যুব সমাজকে দৈহিক ও মানসিক বলে বলীয়ান হয়ে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মোৎসর্গের আহ্বান জানিয়েছিলেন । ভারতীয় যুবক বৃন্দের প্রতি তাঁর উদাত্ত আহ্বান— 'ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত' বহুলাংশে ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল । পরবর্তীকালে শ্রীঅরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতা স্বামী বিবেকানন্দের ধ্যান ধারণা ও স্বদেশ মন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । সন্ন্যাসী হয়েও তিনি ছিলেন অগণিত বিপ্লবীর প্রেরণার উৎস । স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ধর্মীয় মতবাদ ও সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারে সহায়ক হয়েছিল ।

*****

Related Items

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Quit India Movement and the Working Class):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেয় । এই আন্দো

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (The Civil Disobedience Movement and the Working Class) :-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শ্রমিকরা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট শ

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (Workers and Peasants Party) :-

কুতুবুদ্দিন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক হেমন্ত সরকার, সামসুদ্দিন হোসেন প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর বাংলায় 'লেবার স্বরাজ পার্টি অব দা ইন্ডিয়ান

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Non Co-operation Movement and the Working Class):- 

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় সারা ভারতে শ্রমিকরা আন্দোলনে শামিল হয় । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী ওঠে । শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো, ব

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Anti-Partition Movement and the Working Class):-

ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা না করলেও ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত শ্রমিক