বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপ

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 11:10

বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপ (Indian Revolutionary Activities Abroad) :

ভারতের বিপ্লবীদের মতো প্রবাসী ভারতীয়রাও দেশের মুক্তি সাধনের জন্য বিদেশে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত ছিলেন । দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা জুড়ে তাঁদের কর্মকান্ড বিস্তৃত ছিল । বহির্ভারতে এই বিপ্লব প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল মূলত— (ক) ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করা,  (খ) ব্রিটিশের দমন নীতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া, (গ) ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে বিদেশি শক্তিগুলির সাহায্য এবং সহানুভূতি লাভ করে শক্তিশালী আন্দোলনের পথ তৈরি করা ।

ইউরোপে বিপ্লবী কার্যকলাপ (Indian Revolutionary Activities in Europe) :

ইংল্যান্ডে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ছিলেন বিপ্লবীদের অন্যতম নায়ক । সেখানে তাঁর উদ্যোগে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে 'ইন্ডিয়ান হোমরুল সোসাইটি' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সংস্থার মুখপত্র রূপে তিনি 'ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন । ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ইন্ডিয়ান হোমরুল সোসাইটির অন্যতম দাবি । শ্যামজি লন্ডনে 'ইন্ডিয়া হাউসের' প্রতিষ্ঠাতা । ইন্ডিয়া হাউস ছিল লন্ডনে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র । বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শ্যামজির কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন সর্দার সিং রাণা, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, মদনলাল ধিংড়া প্রমুখ বিপ্লবী । ইংল্যান্ডে ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপের ওপর ব্রিটিশ সরকার তীক্ষ্ম নজর রেখেছিলেন । বিপ্লবীদের দমন পীড়ন নির্যাতন চালিয়ে বিপ্লবী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য বিলাতে ভারত সচিবের একান্ত সচিব স্যার কার্জন উইলি বিশেষ তৎপর ছিলেন । ফলে শ্যামজির ঘনিষ্ট সহযোগী মদনলাল ধিংড়া কার্জন উইলিকে হত্যা করে বিপ্লবীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিশোধ নেন । এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লন্ডনে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় । বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে গ্রেপ্তার করে বিচারের জন্য ভারতে পাঠানো হয় । শ্যামজি গ্রেপ্তার এড়িয়ে প্যারিসে চলে যান ।

প্যারিসে ষড়যন্ত্র (Indian Revolutionary Activities in Paris) :

প্যারিস ছিল প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের আর এক কর্মকেন্দ্র । এখানে ভারতীয় বিপ্লবীদের বোমা তৈরির কলাকৌশল শেখানো হত । মহারাষ্ট্রের পি. এন. বাপাত, বাংলার হেমচন্দ্র দাস এখানে এসে বোমা তৈরির কৌশল শিখে গিয়েছিলেন । শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা লন্ডন থেকে প্যারিসে এলে প্যারিসে বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায় । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স মৈত্রী বন্ধনের জন্য প্যারিসে বিপ্লবীদের পক্ষে কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হওয়ায় তাঁদের কর্মকেন্দ্র জার্মানিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ।

জার্মানিতে বিপ্লবী কার্যকলাপ (Indian Revolutionary Activities in Germany) :

জার্মানিতে মাদাম কামা ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে 'ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি' নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন । মাদাম কামা -র প্রকৃত নাম ছিল মাদাম ভিকাজি রুস্তম কামা । মাদাম ভিকাজি রুস্তম কামা বা মাদাম কামাকে 'ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী' বলা হয় । তিনি প্রথমে লন্ডন ও পরে প্যারিসে ভারতীয় বিপ্লবীদের কাজকর্মে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতেন । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সমাজবাদী সম্মেলনে করেন । সেই সম্মেলনে তিনি ভারতের তিন রঙা পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের তীব্র সমালোচনা করেন । ইংল্যান্ডের চিরশত্রু জার্মানির সহযোগিতা গ্রহণের জন্য সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে 'ভারতীয় বিপ্লবী কমিটি' গঠন করেন । এটি বিখ্যাত 'বার্লিন কমিটি' নামে পরিচিত । এই কমিটি শুরুতে 'ইন্দো-জার্মান সোসাইটি' নামে পরিচিত ছিল । বার্লিন কমিটির অন্যতম সদস্যরা হলেন ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ, বীরেন্দ্রনাথ সরকার, মৌলানা বরকতুল্লা, ভবানী মুখোপাধ্যায়, ভাগবান সিং প্রমুখ । ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ, বার্লিনের ভারতীয় ছাত্রদের মধ্য থেকে কর্মী সংগ্রহ এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মুক্তি সংগ্রামে জার্মান সাহায্য সুনিশ্চিত করাই ছিল বার্লিন কমিটির প্রধান কাজ । জার্মান সরকারও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সংগ্রামে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন ।

আমেরিকায় বিপ্লবী কার্যকলাপ (Indian Revolutionary Activities in USA and Canada) :

প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের আর এক কর্মকান্ড ছিল আমেরিকা । বাঙালি বিপ্লবী তারকনাথ দাস কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ' নামে এক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে বিপ্লবের আদর্শ প্রচার করেছিলেন । তিনি কলম্বিয়া থেকে 'ফ্রি হিন্দুস্থান' পত্রিকার সম্পাদনা করে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী জনমত গঠন করে সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন । পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলনের এক পথপ্রদর্শক দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজের ছাত্র লালা হরদয়াল পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে পাঞ্জাব ত্যাগ করেন । প্রথমে জেনিভা শহর ঘুরে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় আসেন । ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে লালা হরদয়ালের উদ্যোগে পণ্ডিত কাঁসিরাম এবং সোহন সিং ভাকনার সহযোগিতায় ক্যালিফোর্নিয়ায় 'গদরপার্টি' নামে এক বিপ্লবী দল এবং তার মুখপত্র গদর প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার প্রবাসী ভারতীয়দের একত্র করে তাঁদের মধ্যে বিপ্লবের আদর্শ দ্বারা দেশের মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তোলা ।  আমেরিকার সরকার যথারীতি বিপ্লবীদের এই সব কাজকর্ম সুনজরে দেখেন নি । ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে সেপ্টেম্বর বাবা গুরদিৎ সিং নামে এক পাঞ্জাবি ৩৭২ জন ভাগ্যান্বেষী শিখ যুবককে নিয়ে যাত্রী বোঝাই জাপানি জাহাজ 'কোমাগাতামারু' করে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে এসে পৌঁছোয় । ব্রিটিশের গোপন নির্দেশে কানাডা সরকার বাবা গুরদিৎ সিংকে আশ্রয় না দিলে জাহাজটি ভারতে কলকাতায় ফিরে আসে । জাহাজের যুবকরা বজবজে অবতরণ করলে শিখযাত্রীদের নানা ভাবে হেনস্তা করা হয় । ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জন শিখ ও ৬ জন পুলিশ নিহত হন । এটি 'বজবজের যুদ্ধ' নামে পরিচিত । অন্যান্যদের কারাদন্ড ও নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল । কোমাগাতামারুর এই ঘটনায় ভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় ।

লালা হরদয়ালকে মনে রাখার কারণ—

(১) সাহারানপুর এবং রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত লালা হরদয়াল ছিলেন পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ।

(২) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে পাঞ্জাবে বিপ্লবী কার্যকলাপ ব্যাপক আকার ধারণ করে । সেই সময় তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘বয়কট’ ও ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের’ ডাক দেন ।

(৩) ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত ছেড়ে বিদেশে চলে যান এবং ১৯১৩ সালে আমেরিকায় প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে গদর পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন । ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে যে-কোনোও উপায়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল এই দলের লক্ষ্য । লালা হরদয়ালের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ।

*****

Related Items

শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের 'সর্বধর্ম সমন্বয়' এর আদর্শ

ঊনিশ শতকে বাংলায় যখন হিন্দুধর্ম নানা কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বেড়াজালে আবদ্ধ এবং ধর্মীয় আন্দোলন যখন নানা মত ও পথের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তখন শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ তুলে ধরে হিন্দুসমাজকে এক নতুন পথের সন্ধান দেন । বিভিন্ন মত ও পথের সংঘর্ষে হ

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী উনিশ শতকের বাংলার এক অন্যরকম সাধক ও ধর্মসংস্কারক ছিলেন । তিনি ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা আগস্ট নদিয়া জেলার দহকুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । শান্তিপুরে গোবিন্দ গোস্বামীর টোলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন । স

ব্রাহ্ম আন্দোলন — বিবর্তন, বিভাজন, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

ব্রাহ্ম আন্দোলন — বিবর্তন, বিভাজন, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা:-

উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে । একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০শে আগস্ট 'ব্রাহ্মসভা' প্রতিষ্ঠা করেন । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্

উনিশ শতকের বাংলা — ধর্মসংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

উনিশ শতকে প্রচলিত হিন্দুধর্ম এক সংকটের সম্মুখীন হয় । পৌত্তলিকতা, বহু দেবতার আরাধনা প্রভৃতি বিষয়ে প্রচলিত হিন্দুধর্মে নানান বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল । এসবের বিরুদ্ধে উনিশ শতকের বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীদের উদ্যোগে হিন্দু

বিধবা বিবাহ আন্দোলন

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ স্বীকৃত ছিল না । অত্যন্ত অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে বয়স্ক এমন কি বৃদ্ধদেরও বিবাহ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল । ফলে অনেক সময় অল্প বয়সেই মেয়েরা বিধবা হত । এর পরিপেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন সমাজসংস্কারক এই সময় বিধবাবিবাহ প