বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা ও রিজলীর প্রস্তাব

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 22:04

বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা ও রিজলীর প্রস্তাব (The Scheme of Partitioning Bengal and the Proposal by H. H. Risely) :

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ভারতের গভর্নর নিযুক্ত হয়ে আসার পর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পীঠস্থান বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হন । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই তিনি এক আদেশ বলে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন । লর্ড কার্জনের আমলে এই সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলেও তিনি এই নীতির উদ্ভাবক ছিলেন না । তখন বাংলা বলতে বোঝাত অখন্ড বঙ্গদেশ, বিহার, ওড়িশাছোটোনাগপুর অঞ্চল । ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল গোয়ালপাড়া, কাছাড় এবং শ্রীহট্টকে নিয়ে আসাম নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠিত হয় । ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন । প্রবল বিরোধিতার জন্য তাঁর সে প্রস্তাব বাতিল হয় । তাঁর উত্তরসুরি হেনরি কটনও এটিকে অবাস্তব ও অসংগত বলে মন্তব্য করেন । ফলে প্রস্তাবটি তখনকার মতো বাতিল হয় । ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ. এইচ. রিজলী উইলিয়াম ওয়ার্ডের প্রস্তাবকে আরও সম্প্রসারিত করে বঙ্গভঙ্গের এক নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন । এতে বলা হয় চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে । উড়িয়া ভাষি অঞ্চলকে বাংলার অবশিষ্টাংশের সঙ্গে যুক্ত করা হবে এবং ছোটনাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হবে । লর্ড কার্জন রিজলীর এই প্রস্তাবকে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে গ্রহণ করেন যা বাংলার মানুষের পক্ষে আরও মারাত্মক হয়েছিল । পরিবর্তিত এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ, মালদহ, পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসামকে একত্রিত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে যার রাজধানী হবে ঢাকা । বাংলার অবশিষ্টাংশ, বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠিত হবে 'বঙ্গদেশ' যার রাজধানী হবে কলকাতা ।  বাংলা তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ছিল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ, কারণ ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যই মূলত বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করা হয়েছিল । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গ-ভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ।

বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য (The Objectives of the Scheme of Partitioning Bengal) :

(ক) বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের সমর্থনে ব্রিটিশ সরকারের যুক্তি ছিল এই যে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে গঠিত অখন্ড বাংলার বিশাল অঞ্চল শাসন করা একজন গভর্নরের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন । তাই প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এবং পিছিয়ে পড়া মুসলিম ও উড়িয়া ভাষীদের উন্নয়নের প্রয়োজনে বঙ্গবিভাজন অপরিহার্য ।

(খ) উনিশ শতকে বাংলা চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও রাজনৈতিক কাজকর্মের প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় ব্রিটিশ স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল । এই আন্দোলনের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে লর্ড কার্জন ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন । বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দূর্বল করে দেওয়াই ছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ।

(গ) বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যাকে পশ্চিমবাংলার জাতীয়তাবাদী চেতনাযুক্ত হিন্দু বাঙালিদের ওড়িয়া ও বিহারিদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার চাপে নতজানু করা এবং পূর্ব বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়কে নতুন প্রদেশ দান করে অনুগত রাখা ছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য । অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের মাধমে অবিভক্ত বাংলাকে ভাগ করে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের আর এক অন্যতম উদ্দেশ্য ।

(ঘ) তৎকালীন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, সচেতনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বাঙালিরা ছিল অগ্রগণ্য, এছাড়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বও তখন ছিল বাঙালিদের হাতে । তাই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাঙালিকে দুর্বল করে জাতীয় কংগ্রেস তথা ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করাই ছিল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য ।

*****

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা