নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিভাজন

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 21:48

নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিভাজন (Division of Moderates and Extremists) :

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্যন্ত সময়্কালকে জাতীয় কংগ্রেসের আদি পর্ব বলা হয় । এই আদি পর্বের নেতৃবৃন্দ উদারনৈতিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁরা মনেপ্রাণে এই ধারণা পোষণ করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনই ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক । এই কারণে তাঁরা ভারতীয়দের দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন নীতি নিয়ে চলার পক্ষে মত পোষণ করতেন । এই আবেদন-নিবেদন নীতিকে কেউ কেউ 'রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি' -র সামিল বলে মন্তব্য করেছেন । জাতীয় কংগ্রেসের আদি পর্বের এইসব আবেদন-নিবেদনে বিশ্বাসী নেতৃবর্গ নরমপন্থী নামে পরিচিত ।

ভারতীয়দের দাবিদাওয়ার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের নিরবিচ্ছিন্ন উপেক্ষার ফলে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বেশকিছু নেতা সন্দিহান হয়ে ওঠেন । পূর্ব ঘোষিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, ইংরেজদের উদারতা ও ন্যায়পরায়নতার প্রতি তাঁরা ক্রমশ আস্থা হারাতে থাকেন । তখনও পর্যন্ত ইংরেজের ন্যায়বোধ সম্পর্কে যাঁদের আস্থা ছিল এবং যাঁরা আবেদন-নিবেদন নীতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত পোষণ করতেন তাঁদের সঙ্গে সরকারি নীতির সমালোচক এই সব নেতাদের তুমুল মতবিরোধ দেখা দেয় । ফলে কংগ্রেসের মধ্যে দুই ভিন্ন মতাবলম্বী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়— একটি নরমপন্থী (Moderates) এবং অন্যটি চরমপন্থী (Extremists) । নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখেল, ফিরোজ শাহ মেহতা, বদরুদ্দিন তায়েবজি, শঙ্করণ নায়ার, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নৌরজি, আনন্দ চার্লু  প্রমুখ ব্যক্তিত্ব । চরমপন্থী নেতারা হলেন মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায়, বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত ইত্যাদি । এঁরা কংগ্রেসি আন্দোলনের প্রথম পর্বের নেতাদের কর্মপদ্ধতিকে ভিক্ষামূলক ও আবেদন এবং নিবেদনমূলক বলে অভিহিত করেছেন । এঁদের অনেক আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কমলাকান্তের দপ্তর -এ কমলাকান্তের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, "জয় রাধেকৃষ্ণ, ভিক্ষা দাও গো— এটাই আমাদের পলিটিক্স ।"  বাস্তবিক পক্ষে কংগ্রেসের প্রথম যুগে জাতীয়তাবাদী নেতারা যেসব সংস্কার প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, সেগুলি সরকার খুব কমই রূপায়িত করেছিল । ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও নরমপন্থীরা দেশের দুঃখ দারিদ্র পীড়িত, জাতপাত ও কুসংস্কারের বেড়া জালে আবদ্ধ অশিক্ষিত ভারতবাসীর উন্নতির জন্য কোনো কার্যকর ভুমিকা গ্রহণ করতে পারেনি । ফলে জাতীয় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হ্রাস পায় । ১৮৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষ বোম্বাই -এর ইন্দুপ্রকাশ পত্রিকায় লেখেন "কংগ্রেস ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছেছে ।" এই অবস্থায় চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ সরকার বিরোধিতা এবং সরকারি নীতির সমালোচনার পাশাপাশি দেশকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার ওপর জোর দেন । তাঁদের প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলার মানুষ আত্মনির্ভরশীল হতে শেখেন । বিশ শতকের সূচনায় স্বদেশি আন্দোলনের পাশাপাশি দেশে চরমপন্থী আন্দোলনও শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে । জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি শাসকবর্গের বিমাতৃসুলভ মনোভাব, দেশীয় জনসাধারণের প্রতি চরম অবহেলা এবং ঔদাসীন্য চরমপন্থী নেতৃবৃন্দকে ক্রমশ আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য করে । কংগ্রেসের মধ্যে মধ্যপন্থীদের প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকে এবং চরমপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে । চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের 'আবেদন-নিবেদননীতি' পরিত্যাগ করে ভারতীয়দের অভাব অভিযোগ নিরসনের জন্য ও নিজেদের অধিকার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করে নেওয়ার জন্য দেশে চরমপন্থী আন্দোলনের কর্মতত্পরতা শুরু করেন ।

*****

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা