হিমবাহের কাজ ও শ্রেণিবিভাগ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 05/23/2012 - 07:29

হিমবাহের কাজ (Work of Glaciers) : পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলে ও উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে অত্যধিক ঠান্ডা । এইসব অঞ্চলে তুষারক্ষেত্র ও হিমবাহ দেখা যায় । অত্যধিক শীতের জন্য পর্বতের উঁচু চুড়ায় ও মেরু অঞ্চলের বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্প সারা বছর তুষারে জমে থাকে । পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের প্রধান কাজ ভূমি ক্ষয় করা (ক্ষয়্সাধান) এবং ক্ষয়ীভূত শিলাচূর্ণ বহন করা (বহন) । পার্বত্য অঞ্চল থেকে নামার পরে হিমবাহের প্রধান কাজ বাহিত শিলা চূর্ণ ও নুড়ি-পাথর জমা করা অর্থাৎ অবক্ষেপণ বা সঞ্চয় ।    

হিমরেখা (Snow Line) : মেরুপ্রদেশ ও উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের তীব্র শৈত্যে, যে সীমারেখার উপরে অত্যধিক শীতলতার জন্য সারা বছর তুষার জমে থাকে এবং নীচে উত্তাপে তুষার গলে যায় তাকে সেই সীমারেখাকে হিমরেখা । হিমরেখার ওপরে থাকে চির তুষারক্ষেত্র । হিমরেখার ঊর্ধ্বে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তে সর্বদা তুষারপাত হয় । ক্রমাগত সঞ্চয় এবং পারস্পারিক চাপের ফলে প্রাথমিক আলগা তুষার কণাগুলি কালক্রমে দৃঢ়সংবদ্ধ  হয়ে বরফে পরিণত হয় । পৃথিবীর সর্বত্র হিমরেখা একই উচ্চতায় অবস্থান করে না । অক্ষাংশ, উচ্চতা ও জলীয়বাষ্পের পরিমানের উপর হিমারেখার সীমা নির্ভর করে । মেরুপ্রদেশে হিমরেখা সমুদ্র সমতলে, নিরক্ষীয় অঞ্চলে হিমারেখা ৫৫০০ মিটার উচ্চতায়, পূর্ব হিমালয়ে হিমরেখা ৩৯৬০ মিটার, পশ্চিম হিমালয়ে ৩৮০০ মিটার, মধ্য আল্পস পর্বতে হিমরেখা ২৭০০ মিটার এবং আন্দিজ ও কিলিমাঞ্জারো পর্বতে হিমরেখা ৫৪৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করে । এইসব অঞ্চলে হিমরেখার ঊর্ধ্বে  সারা বছরই তুষার জমে থাকে ।

হিমবাহ (Glacier) : হিমারেখার উপরে তুষারক্ষেত্র । সেখানে যে তুষারপাত হয় তা প্রথম অবস্থায় আলগা আলগা হয়ে পড়ে থাকে । ফরাসি ভাষায় একে নেভে [Neve] বলে । এই তুষারকণা ক্রমশ পরস্পরের সঙ্গে মিশে বরফের স্থরে [Ice Sheet] এ পরিণত হয় । ক্রমশ আরও জামাট বেঁধে ও আয়তনে বড় হয়ে বরফের স্তুপের আকার ধারণ করে । তারপর উপরের চাপ ও বরফের নিজস্ব উষ্ণতায় নীচের কিছু বরফ গলে গেলে সেই বরফের স্তুপ পর্বতের ঢালে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করে । এই চলমান বরফের স্তুপকে হিমবাহ বলা হয় । প্রকৃতপক্ষে হিমবাহ এক বরফের নদী । নদীর মত হিমবাহ দুরন্ত গতিশীল নয় ।  দিনে হিমবাহের গতি কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র ।

উদাহরণ: যমুনা নদী যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ।

হিমানী-সম্প্রপাত : পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে পার্বত্য অঞ্চলে হিমরেখার উপরে অর্থাৎ তুষারক্ষেত্রের জমাট বাঁধা বরফ অত্যন্ত ধীরগতিতে পর্বতের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসতে থাকে । কখনো কখনো পাহাড়ের ঢালে চলমান এইরকম হিমবাহ থেকে বিশাল বরফের স্তূপ ভেঙে প্রচন্ড বেগে নীচের দিকে পড়তে দেখা যায়, একে হিমানী সম্প্রপাত বলে । বিশাল আকৃতির হিমানী সম্প্রপাতের ফলে নিকটবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় ও এই হিমানী-সম্প্রপাতের গতি পথে অবস্থিত বাড়িঘর, গাছপালা প্রভৃতি ধ্বংস হয়ে যায় ।

হিমবাহের শ্রেণিবিভাগ: হিমবাহ প্রধানত তিন প্রকার, যথা- (ক) উপত্যকা হিমবাহ বা পার্বত্য হিমবাহ, (খ) মহাদেশীয় হিমবাহ, (গ) পাদদেশীয় হিমবাহ

(ক) উপত্যকা হিমবাহ (Valley Glacier) বা পার্বত্য হিমবাহ (Mountain Glacier) : উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিংবা অতি উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচন্ড ঠান্ডার জন্য তুষার জমে সৃষ্টি যেসব হিমবাহ পর্বতের উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং যেসব হিমবাহ তাদের গতি প্রবাহকে পার্বত্য উপত্যকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে, সেইসব হিমবাহকে পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ বলে ।

উদাহরণ:- (১) হিমালয়ের উত্তরে কারাকোরামের সিয়াচেন হিমবাহ (দৈর্ঘ ৭২ কিমি); বিয়াফো (৬৩ কিমি ) ও বলটারো (৫৮ কিমি), হিসপার (৫০ কিমি.) ও বাতুরা (৬০ কিমি); (২) কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ (দৈর্ঘ ৩৯ কিমি এই হিমবাহ থেকে গঙ্গানদীর উৎপত্তি হয়েছে), কেদারনাথ (১৪ কিমি.) কাঞ্চন জঙ্ঘার জেমু হিমবাহ (দৈর্ঘ ২৬ কিমি এর থেকে তিস্তা নদীর উৎপত্তি হয়েছে) প্রভৃতি হিমালয়ের উপত্যকা হিমবাহ গুলি দৈর্ঘ্যে পৃথিবীর অন্যতম ।

(খ) মহাদেশীয় হিমবাহ (Continental Glacier) : মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে হিমবাহ অবস্থান করে তাকে মহাদেশীয় হিমবাহ বলে । সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চল জুড়ে যে বিরাট বরফের স্তর দেখা যায় তাকেই আসলে মহাদেশীয় হিমবাহ বলে । তুষারযুগে মহাদেশগুলির অনেক অঞ্চল বরফের স্তর দ্বারা আবৃত ছিল । ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে মহাদেশীয় হিমবাহের বিস্তার হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দুটি মেরু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে ।

উদাহরণ : অ্যান্টার্কটিকার ল্যাম্বার্ট হিমবাহটি পৃথিবীর দীর্ঘতম মহাদেশীয় হিমবাহ । গ্রিনল্যান্ডেও এই রকম হিমবাহ দেখা যায় ।

(গ) পাদদেশীয় হিমবাহ (Piedmont Glacier) :  হিমবাহ যখন উঁচু পর্বতের থেকে নেমে এসে পর্বতের পাদদেশে বিরাট অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে, তখন তাকে পাদদেশীয় হিমবাহ বলে ।  উচ্চ অক্ষাংশে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশে উষ্ণতা কম থাকায় সহজেই পাদদেশীয় হিমবাহ সৃষ্টি হয় ।

উদাহরণ: আলাস্কার মালাসপিনা হিমবাহটি হল পৃথিবীর বৃহত্তম পাদদেশীয় হিমবাহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, এটি প্রায় ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত।

*****

Related Items