দেশীয় নাট্যাভিনয় আইন (The Dramatic Performances Act -1876) :
ঊনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয়দের প্রতি সমকালীন ব্রিটিশ শাসকদের ঘৃণা, অসম্মানজনক ও বৈষম্যমূলক আচরণ, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে ইংরেজদের ভারতীয়দের প্রতি প্রচন্ডভাবে অবজ্ঞা করা, প্রশাসনিক, সামরিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রাতেও ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবজ্ঞা, সর্বসাধারণের ব্যবহারের জায়গা যথা— রেল, স্টিমার. হোটেল, খেলার মাঠ, ক্লাব, রাজপথ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষণ, বিচারব্যবস্থায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রকট বৈষম্য, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতি স্থানে ভারতীয়দের প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা, অপমান, ইংল্যান্ডের স্বেচ্ছাচারী অর্থনৈতিক শোষণ, ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহের উৎস ও ভোগ্যপণ্যের খোলা বাজারে পরিণত করা, উপযুক্ত যোগ্যতা ও শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরি থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বঞ্চনা, নারীনিগ্রহ ইত্যাদি নানান ঘটনা জাতীয়তাবাদী নাটকের মাধ্যমে জনগণের সীমাহীন দুর্দশার জ্বলন্ত চিত্র তুলে ধরা হয় । ফলে ক্রমপুঞ্জিত অসন্তোষ ও ক্ষোভ ভারতীয় জনমনে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল । এর ফলস্বরূপ সরকার ব্রিটিশ-বিরোধী নাটকের অভিনয় যাতে না হয় সে জন্য সচেষ্ট হন এবং লর্ড নর্থব্রুকের শাসনকালে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই মার্চ ‘নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ বলবৎ করা হয় । এই আইন অনুসারে সরকারের অনুমতি ভিন্ন কোনো নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চরম অসন্তোষ, তীব্র প্রতিক্রিয়া ও গণ আন্দোলনের সূচনা হয় । বিভিন্ন সংস্থা, যেমন; ‘সাধারণ’, ‘বেঙ্গলী’ প্রভৃতি সংবাদ পত্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিশেষত ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’, ভারত সভা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ।
এই আইনে উদ্দেশ্য ছিল—
(১) নাটকের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে যে দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধের বিস্তার ঘটছিল তা বন্ধ করা ।
(২) ব্রিটিশ সরকারের জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি রক্ষা করা ।
(৩) যে কোনো রাজনীতি বিষয়ক নাটক ও অভিনয় নিয়ন্ত্রিত করা ।
ঊনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে অভিনীত কতকগুলি দেশীয় নাটক জনমনে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল । কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পন' নাটকের অভিনয় দেখতে এসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানুষ ও উত্তেজিত হয়ে অত্যাচারী ও ব্যভিচারী রোগ সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় রত অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির উদ্দেশ্যে তাঁর চটিজুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন । এই ঘটনা প্রমাণ করে একটা নাটক জনমানসে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে । ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের যুবরাজ এডওয়ার্ড তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতায় এলে হাইকোর্টের উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অন্তঃপুরের মহিলাদের দিয়ে তাঁর অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন । তাঁর এই রাজভক্তিকে ব্যঙ্গ করে 'গজদানন্দ ও যুবরাজ' নামে একটি প্রহসন রচিত হয় ও তা ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেরুয়ারী গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলে ব্রিটিশ পুলিশবাহিনী তা বন্ধ করে দেয় । পরে অমৃতলাল বসু ও উপেন্দ্রনাথ দাশ 'হনুমান চরিত্র' নাম দিয়ে প্রহসনটি মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নিলে পুলিশী হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায় । এরপর উপেন্দ্রনাথ দাশ রচিত 'সরোজ সরোজিনী' ও 'সুরেন্দ্র বিনোদিনী' নাটকের অভিনয় একই কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয় । 'সুরেন্দ্র বিনোদিনী' নাটকের একটি দৃশ্যে এক ইংরেজকে জুতো মারার দৃশ্য ইংরেজ মহলে প্রচন্ড উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল ।
*****
- 9587 views