ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Iswarchandra Vidyasagar) :
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হলেন উনবিংশ শতাব্দীর সমাজ-সংস্কার ও শিক্ষা প্রসার আন্দোলনের প্রাতঃস্মরনীয় মহাপুরুষ । তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভগবতী দেবী । কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিনি পড়াশুনা করেন । ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায়, জ্যোতিষ ও ধর্মশাস্ত্র বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এবং পরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন । সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষরূপে তিনি এই কলেজের আমূল সংস্কার ও পুনর্গঠন করেছিলেন । মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বই লেখার কাজে ব্রতী হন । বাংলা গদ্য তখনও গড়ে ওঠেনি । কেবল রাজা রামমোহন রায় আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত কিছুটা এই বিষয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন । এঁদের রচনা ছিল বেশ আড়ষ্ট ও জটিল । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা গদ্যকে সরস ও মধুর করে সাধারণের হৃদয়বেদ্য করে তুলেছিলেন । এজন্য তিনি 'বাংলা গদ্যের জনক' নামে খ্যাত । সে যুগে বাঙালি ছাত্রদের উপযোগী কোনো পাঠ্যপুস্তক ছিল না । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাদের জন্য প্রথম বর্ণপরিচয়, কথামালা, ঋজুপাঠ, আখ্যানমঞ্জরী, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তক লেখেন । অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থের মধ্যে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস', 'ভ্রান্তিবিলাস', প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
শিক্ষা বিস্তার (Educational Reforms) :
শিক্ষা প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান—
(ক) শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে ।
(খ) স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি রামগোপাল ঘোষ, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ব্যক্তিদের সাহায্য ও সহযোগিতা পান । বিদ্যালয় পরিদর্শকের সরকারি পদে থাকার সুবাদে তিনি ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় এবং ১০০ টি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন । এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় ’ বর্তমান বেথুন স্কুল স্থাপন করা । সংস্কৃত-শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি সংস্কৃত কলেজে অ-ব্রাহ্মণ শ্রেণির ছাত্রদের ভর্তির ব্যবস্থা করেন ।
(গ) ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর গ্রাম বীরসিংহে একটি অবৈতনিক 'ইঙ্গ সংস্কৃত বিদ্যালয়' স্থাপন করেন । উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি 'মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন' প্রতিষ্ঠা করেন ।
(গ) গণশিক্ষার প্রসারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের গুরুত্ব অনুভব করেন । এই জন্য তিনি সহজ-সরল পাঠ্যপুস্তক রচনায় আগ্রহী হন । শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি বর্ণপরিচয়, কথামালা, ঋজুপাঠ, আখ্যানমঞ্জরী, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তক লেখেন । অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থের মধ্যে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস', 'ভ্রান্তিবিলাস', প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
সমাজ সংস্কার (Social Reforms) :
সমাজ-সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান—
বাংলার সংস্কার আন্দোলন, বিশেষত নারীকল্যাণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান চিরস্বীকার্য । উনিশ শতকের নবজাগরণ ছিল তাঁর সমাজ-সংস্কার ও শিক্ষা প্রসার আন্দোলনের সার্থক পরিণতি ।
(১) পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যকলাপ বাংলা তথা ভারতের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে । বাল্য বিবাহ নিবারণ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণীয় । তাঁর প্রচেষ্টায় গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহকে আইন সিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন । এছাড়া প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিটাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয় ।
(২) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে ধর্মকে সংযুক্ত না করে মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হন । বিদ্যাসাগর ছিলেন একক সংগ্রামী— তিনি কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে প্রয়াসী হননি । রাজা রামমোহনের মতো ব্রাহ্মসমাজ অথবা ডিরোজিও -র নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেননি ।
ভারতীয় নারীদের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান (Contribution of Iswarchandra Vidyasagar for Welfare of Indian women)
উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় । পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এই সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ । তাঁর পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল । প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সামাজ জীবনকে কলুষমুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন । উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কারের প্রধান দিকটি ছিল নারী জাতির কল্যাণসাধন ।
(১) উনবিংশ শতকের এক বিরাট পণ্ডিত ও মহান সমাজ-সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । সারাজীবন ধরে তিনি সমাজ-সংস্কারে ব্রতী থাকেন । বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে । বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন ।
(২) হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন ।
(৩) বহুবিবাহ, বাল্য-বিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল জনমত গড়ে তোলেন । শেষ পর্যন্ত তাঁর আন্দোলন সফল হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ হয় ।
(৪) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর বাল্য-বিবাহের বিরুদ্ধে জোর প্রচার শুরু করেন এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদন পত্র সরকারের কাছে পেস করেন । প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিটাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয় ।
(৫) নারীশিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারেও তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না । বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে থাকার সু্যোগে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন । এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ বর্তমান বেথুন স্কুল স্থাপন করা ।
*****
- 18850 views