শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের অবদান ও রাজনীতির ক্ষেত্রে এই আন্দোলনের ফলাফল আলোচনা কর ।

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 01/09/2022 - 14:18

প্রশ্ন:- শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের অবদান ও রাজনীতির ক্ষেত্রে এই আন্দোলনের ফলাফল আলোচনা কর ।

শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের প্রভাব : আলিগড় আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ । পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত । স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজি ভাষার মাধমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রগতির যথার্থ সোপান বলে মনে করতেন । তাই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারে উদ্যোগী হন ।

(১) ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাজিপুরে একটি ইংরেজি স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন ।

(২) ইংরেজি ভাষায় লেখা মূল্যবান কিছু কিছু বই উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে তা মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করার উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞান সমিতি (Scientific society) নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন ।

(৩) তিনি মুসলমানদের মন থেকে পাশ্চাত্যের ভয়-ভীতি দূর করার জন্য ‘তাহজিব-উল-আখলার্ক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । সেই সঙ্গে 'কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লারনিং' নামে একটি সংস্থাও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ।

(৪) অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলিগড়ে তিনি মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ -এর প্রতিষ্ঠা করেন । ইংরেজ শিক্ষাবিদগণের তত্ত্বাবধানে এই কলেজে কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় । মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও প্রগতিমূলক মনোভাবের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে এই কলেজের অবদান অস্বীকার করা যায় না ।

(৫) আলিগড় আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদের আধুনিক যুগোপযোগী ভাবধারায় দীক্ষিত করেছিল ।

(৬) এই আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটিয়ে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি পরিত্যাগেও সাহায্য করেছিল ।

(৭) এই আন্দোলন মুসলিম সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি, পর্দা প্রথার অপসারণ ও নারী শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ।

কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলমানগণ আলিগড়ের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল । শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের মুসলমানরাই আলিগড় কলেজে শিক্ষার সুযোগ পায় ।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের ফলাফল :

(১) আলিগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে ।

(২) আলিগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঘোর সাম্রাজ্যবাদী থিওডোর বেক -এর প্রভাবে আলিগড় আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমদ ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার নীতি গ্রহণ করেন । ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা রুখতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তিনি ‘এডুকেশানাল কংগ্রেস’, ‘ইউনাইটেড পেট্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন’ ও 'মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে তিনি কংগ্রেসের তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা গঠন করেন ।

(৩) আলিগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার অপূর্ব সুযোগ পায় এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতিতে তোষণ করতে শুরু করে । বঙ্গভঙ্গ ছিল ইংরেজ সরকারের সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির প্রথম দৃষ্টান্ত ।

(৪) সর্বোপরি আলিগড় আন্দোলনের কার্যকলাপ পরাধীন ভারতের রাজনীতিতে দ্বিজাতি তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয় ।

এইসব দোষত্রুটি সত্ত্বেও ভারতীয় মুসলমান সমাজের নবজাগরণে স্যার সৈয়দ আহমদ তথা আলিগড় আন্দোলনের অবদান অস্বীকার করা যায় না । তাই আলিগড় আন্দোলনের অবদান প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার সঠিক মন্তব্য করে বলেছেন যে, ‘উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুদের কাছে যা ছিল, আলিগড় আন্দোলনেও ছিল মুসলিমদের কাছে ঠিক তাই’।

*****

Comments

Related Items

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন (Women and the Anti-partition Movement):-

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনকালে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে বাংলা তথা ভারতে এ

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Women's Movements in the Twentieth Century):-

বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্ব

মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলন

মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলন(M.N.Roy and the Left Movement in India):-

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আসল নাম হল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য । বিপ্লবী কাজ করতে গিয়ে তিনি অসংখ্য ছদ্মনাম গ্রহণ করেন, যেমন— মি. মার্টিন, হরি সিং, ডা. মাহমুদ, মি.

বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণ

বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণ (Participation of the Left in the Anti-Colonial Movement in India):-

রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি সহ ২৪ জন প্রবাসী ভারতীয়

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Quit India Movement and the Working Class):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেয় । এই আন্দো