Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 22:30

রাজা রামমোহন রায় (Raja Rammohan Roy) :

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক আবর্তে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল এবং নানা কুসংস্কারের চাপে সমাজের স্বাভাবিক ধারা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে পুনরায় যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়, তাকেই বাংলার নবজাগরণ বলা হয়  । পঞ্চদশ শতাব্দিতে ইটালিতে যে নবজাগরণ হয় তা যেমন কালে কালে সমগ্র ইউরোপে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল বাংলার নবজাগরণ তেমনি ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতভূমিকে প্লাবিত করেছিল । পেত্রার্কবোকাচ্চিও যেমন ইটালির নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত । ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মে (মতান্তরে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ই আগস্ট) হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায় জন্ম গ্রহণ করেন । রাজা রামমোহন রায় পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল । প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে কলুষ মুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন ।

শিক্ষা সংস্কার (Educational Reforms) :

স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের প্রীতি ও শ্রদ্ধা ছিল সুগভীর এবং দেশবাসীর সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য তিনি সারা জীবন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন । ভারতীয় সমাজের দুরবস্থা ও সমকালীন দুর্নীতি তাঁকে ব্যথিত করেছিল । সে সময়ে সমাজে জাতপাতের বিচার ছিল প্রবল, ধর্ম ছিল কুসংস্কারে ভরা এবং ধর্মের নামে অশিক্ষিত ও দুর্নীতিপরায়ন পুরোহিত শ্রেণির আধিপত্য ছিল প্রবল । উচ্চশ্রেণির মানুষ ছিল স্বার্থপর । নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও তাঁরা কুন্ঠিত হতেন না । প্রাচ্যের ঐতিহ্যময় দার্শনিক তত্ত্বের প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের শ্রদ্ধা ছিল অগাধ, কিন্তু সেই সঙ্গে ভারতীয় সমাজের পুনরুজ্জীবনের জন্য পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মনোভাব ও মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের সংকল্প । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার ফলে তাঁর চরিত্রে বহুত্বের এক বিরাট সমন্বয় ঘটেছিল বলে তাঁকে 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক পূর্ণ সমন্বয়ের প্রতীক' বলে অভিহিত করা হয়েছে ।

ধর্ম সংস্কার (Religious Reforms):

রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের সময় থেকে বাংলা তথা ভারতে নবজাগরণের সূত্রপাত হয় । বেদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, উপনিষদ, গীতা, ভাগবত, জেন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক ইত্যাদি সকল ধর্মশাস্ত্র গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়নের পর তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে সকল ধর্মই মূলত এক । একই ঈশ্বরে বিশ্বাস সকল ধর্মের মূল কথা । সামাজিক ও ধর্মীয় আচার আচরণ ও বাধা নিষেধের কোনো মূল্য নেই । রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত করার জন্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে 'আত্মীয় সভা' (Atmiya Sabha) গঠন করেন । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি একে 'ব্রাহ্মসভা'য় (Brahmo Sabha) পরিণত করেন । ১৮২৮ এটি আবার 'ব্রাহ্মসমাজ' (Brahmo Samaj) নামে পরিচিত হয় । ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক । তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর হবে । 

সমাজ সংস্কার (Social Reforms):

রাজা রামমোহন রায় সমাজ সংস্কারের দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন । ভারতীয় নারীদের জন্য রাজা রামমোহন রায়ের  চিরস্মরণীয় অবদান হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো ।

(১) সতীদাহ প্রথা (Practice of Sati) :- রাজা রামমোহন রায়ের চিরস্মরণীয় পদক্ষেপ হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো । তত্কালে হিন্দু সমাজে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবাদের পুড়ে মরতে হত । মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবাদের সহমরণকে ‘সতীদাহ প্রথা’ বলা হত । প্রাচীনকাল থেকে এই প্রথার চল ছিল । এই নিষ্ঠুর প্রথা দূরীকরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রাজা রামমোহন রায় এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন । তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে এই মত প্রচার করেন যে, সতীদাহ প্রথা ধর্মবিরুদ্ধ, সেই সঙ্গে তিনি জনমত গড়ে তোলেন । তাঁর প্রচেষ্টায় বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তদশ-বিধি’ নামে আইন পাস করে এই বর্বর 'সতীদাহ প্রথা' নিষিদ্ধ করেন ।

(২) বহু-বিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও রাজা রামমোহন রায় তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যান ।

(৩) নারী ও পুরুষের সমানাধিকার ।

(৪) নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারেও রামমোহন রায়ের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না । যদিও নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর আগ্রহের অভাব কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ।

(৫) রাজা রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারাই ভারতীয়দের উন্নতি সম্ভব হবে । তাই যাতে ভারতে রসায়ন শাস্ত্র, শারীরবিদ্যা, চিকিত্সাশাস্ত্র প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় তার জন্য তিনি লর্ড আমহার্স্টকে পত্র লিখেছিলেন । কিন্তু তাঁর দাবি উপেক্ষিত হয় । সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে দূরদর্শী রাজা রামমোহন রায়, রাজা রাধাকান্ত দেব, ভূকৈলাসের জয়নারায়াণ ঘোষাল ও মহাপ্রাণ ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারী হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন । যেটি পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার আইন অনুযায়ী যে এক লক্ষ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়, তার পিছনেও রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফকে জেনারেল অ্যাসেম্বলী ইনষ্টিটিউশন বা স্কটিশ চার্চ কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন । 

বিবিধ সংস্কার (Miscellaneous Reforms) :

(১) বাংলা গদ্য সাহিত্যে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য । তিনি ধর্ম সংস্কারর জন্য যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি বাংলা গদ্যের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল । তিনি গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে একটি ব্যাকরণও রচনা করেন । তাঁর পূর্বে বাংলা ভাষায় দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাস নিয়ে কোনও গ্রন্থাদি রচিত হয় নি ।

(২) সংবাদপত্রের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে ভারতবাসীকে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দেবার দাবি জানিয়ে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের 'প্রেস রেগুলেশন' এর প্রতিবাদ জানিয়ে রাজা রামমোহন রায় সুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত পেশ করেছিলেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের বৈষম্যমূলক 'জুরি আইন' বন্ধ করার জন্য এবং কৃষকদের ওপর করের বোঝা কমাবার জন্য রাজা রামমোহন রায় বহু চেষ্টা করেন ।

(৩) ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ প্রাপ্তির সময় রাজা রামমোহন রায় বিলাতের পার্লামেন্টে যে প্রতিবেদন পাঠান, তা তাঁর প্রগতিশীল অর্থনৈতিক চিন্তার পরিচায়ক । তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শোষিত কৃষককুলের সপক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন । নতুন সনদে তিনি কৃষকদের স্বার্থরক্ষা জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান ।

(৪) ভারতীয়দের অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদ গ্রহণ, স্বাধীনতা এবং মানবাত্মার মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় রাজা রামমোহন রায় উল্লেখ যোগ্য অবদান রেখে গেছেন । উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ, সংস্কৃতি এবং বাঙালির মনে রাজা রামমোহন রায়ের সুস্পষ্ট প্রভাব বর্তমান ।  তাই তাঁকে বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের জনক বা আধুনিকতার অগ্রপথিক রূপে বর্ণনা করা হয় । ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে রাজা রামমোহন রায়ের জীবনাবসান হয় । 

উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল

(১) যুক্তিবাদী হয়ে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা ও কুসংকারের উচ্ছেদ ঘটানো ।

(২) জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করা ।

(৩) ধর্মের নামে অধর্ম এবং সামাজিক অত্যাচারের প্রতিকার করা ।

(৪) নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে নারীসমাজের মান উন্নয়ন ঘটানো ।

(৫) নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ভেদবুদ্ধি ত্যাগ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা এবং দেশাত্মবোধ জাগরিত করা ।

(৬) সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো ।

*****

 

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?