প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারত (India After World War I)

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 06/28/2013 - 19:11

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে নানা পরিবর্তন (Post war India) :

১) ভারতবাসীর হতাশা ও অসন্তোষ : বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতেও পড়েছিল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত ছিল ব্রিটেনের শক্তির প্রধান উৎস । যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ ভারতকেও একটি যুদ্ধরত দেশ বলে ঘোষণা করেছিল, যাতে যুদ্ধে ভারতীয় লোকবল ও সম্পদ ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায় । ভারতীয়দের মতামত না নিয়েই ভারতকে যুদ্ধে জড়ানো হয়েছে, এজন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ স্বভাবতই ক্ষুন্ন হয়েছিলেন । তা সত্ত্বেও স্বেচ্ছাচারী শক্তির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির সংগ্রামে তাঁরা ব্রিটেনকে সমর্থন করেছিলেন । তৎকালীন ভারতসচিব এডউইন মন্টেগু ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে—

(ক) নতুন শিল্পগঠনের মাধ্যমে ভারতের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো হবে ও

(খ) শাসন সংস্কারের মাধ্যমে ভারতীয়দের বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণ করা হবে ।

ব্রিটিশের এই মনোভাব লক্ষ করে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতারা, এমনকি চরমপন্থী নেতা লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক ব্রিটিশ সরকারকে সমস্ত রকম সাহায্য করার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে আহ্বান জানান । ফলে ভারতীয়রা অর্থ, অস্ত্র, রসদ, সেনা ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে সাহায্য করে । তাঁদের আশা ছিল যুদ্ধের অবসানে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে যত্নবান হবেন । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্রিটেন সেই প্রতিশ্রুতি পালনে মোটেই উৎসাহ দেখায় নি । ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য পরাধীন জাতিগুলির মতো ভারতবাসীদের মনে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দেয় ও ভারতবাসীর মোহভঙ্গ হয় ।

২) অর্থনৈতিক সংকট : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে গভীর অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম খুব বেড়ে যায় । অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । বিদেশি জিনিসপত্রের আমদানি আবার শুরু হয় ও ভারতীয় শিল্পজাত জিনিসপত্রের ওপর চড়া হারে শুল্ক ধার্য হয়, ফলে ভারতের শিল্পসংস্থাগুলির বেশির ভাগই লোকসান সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায় । এর ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে-

(ক) ভারতে অসংখ্য শিল্প-শ্রমিক ও মজুর বেকার হয়ে পড়ে ।

(খ) কৃষিজমির ওপর খাজনার হার বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের দারিদ্র চরমে ওঠে ।

(গ) যুদ্ধ শেষ হলে ভারতীয় সেনা ও সামরিক কর্মচারীদের বেশির ভাগই ছাঁটাই হয়ে বেকারে পরিণত হয় ।

৩) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন (মন্টেগু-চেমস্‌ফোর্ড শাসন সংস্কার) : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতবাসীদের খুশি করার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন পাস করা হয় । কিন্তু এই আইনে ভারতকে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করার কোনো উল্লেখ না থাকায় এই আইন ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করতে পারেনি ।

৪) ভারতীয় মুসলমান সমাজের ক্ষোভ : তুরস্ক সাম্রাজ্যের প্রধান ছিলেন খলিফা । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করার অপরাধে ব্রিটেন তথা মিত্রশক্তি খলিফাকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করে এবং তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিচ্ছেদ ঘটায় । তুরস্কের সুলতানের অবমাননার প্রতিবাদে বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে ভারতীয় মুসলমানরা যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে তা খিলাফৎ আন্দোলন নামে পরিচিত । তুরস্কের খলিফাকে তাঁর পদে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে খিলাফৎ আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে । ইতিমধ্যে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মুস্তাফা কামাল তুরস্কে খলিফাতন্ত্রের অবসান ঘটালে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয় ।

*****

Related Items

প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ (Resistance and Rebellion) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করতে শুরু করে । এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে ভারতের বি

উনিশ শতকের বাংলার 'নবজাগরণ' ধারণার ব্যবহার বিষয়ক বিতর্ক

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় কেউ কেউ তাকে 'নবজাগরণ' বলে অভিহিত করেছেন । প্রকৃত অর্থে এই অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলা যায় কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও পন্ডিতমহলে বিতর্কের শেষ নেই । ঐতিহাসিক যদুনাথ

বাংলার নবজাগরণ -এর চরিত্র ও পর্যালোচনা

ঊনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় । এই অগ্রগতি সাধারণভাবে 'ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ' নামে পরিচিত । রেনেসাঁস (Renaissance) কথাটির আক্

লালন ফকির

ঊনিশ শতকে বাংলায় সর্বধর্মসমন্বয়ের ক্ষেত্রে যাঁরা গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছিলেন লালন ফকির বা লালন সাঁই হলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম আধ্যাত্মিক বাউলসাধক । তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও বাংলাদেশের বাউলগানের শ্রেষ্ঠতম রচয়িতা ছিলেন । তিনি সাধারণ মানুষের কাছে লালন ফকির ...

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ : নব্য বেদান্ত — বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

ভারতের প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যাকর্তা ছিলেন আদি জগৎগুরু 'শঙ্করাচার্য' । 'বেদান্ত' শব্দের অর্থ হল বেদের অন্ত বা শেষ, আর বেদের অন্ত হল উপনিষদসমূহ । ব্রহ্ম হল বেদান্ত দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয় । উপনিষদ, ভগবতগীতা এবং ব্রহ্ম সূত্র ও তার ভাষ্য বি