হোমরুল আন্দোলন (Home Rule Movement) :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হোমরুল আন্দোলন ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্দীপ্ত করেছিল । শ্রীমতী অ্যানি ব্যাসান্ত আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতা রেমন্ড -এর হোমরুল লিগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে এই আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন । জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠনের মাধ্যমে ভারতকে একটি স্বশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করাই ছিল হোমরুল আন্দোলনের লক্ষ্য । স্বায়ত্তশাসন ব্যতীত ভারতীয়দের উন্নতি সম্ভব নয়— শ্রীমতী অ্যানি ব্যাসান্তের এই প্রস্তাব সমকালীন কংগ্রেস নেতাদের পছন্দ না হওয়ায় তিনি নিজের উদ্যোগেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের আডিয়ারে হোমরুল লিগ স্থাপন করেন । ওই একই বছর বালগঙ্গাধর তিলক পুণায় ভারতীয় হোমরুল লিগ স্থাপন করেন । যোশেফ ব্যাপটিস্টা ভারতীয় হোমরুল লিগের সভাপতি এবং এন. সি. কেলকার এর সম্পাদক নিযুক্ত হন । শ্রীমতী ব্যাসান্তের অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য অল্পদিনের মধ্যেই বোম্বাই, কানপুর, এলাহাবাদ, বারাণসী প্রভৃতি শহরে হোমরুলের কর্মকেন্দ্র স্থাপিত হয় । 'নিউ ইন্ডিয়া' এবং 'কমন উইল' পত্রিকা দুটি প্রকাশের মাধ্যমে শ্রীমতী ব্যাসান্ত তাঁর হোমরুল আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন । বালগঙ্গাধর তিলকও দেশের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতবাসীর মনে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা সঞ্চার করেন । তিলকের দাবি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেই ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসন । তিনি তাঁর 'মারাঠা' ও 'কেশরী' পত্রিকা দুটির মাধ্যমে নিয়মিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখে হোমরুল আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন । ক্রমশ তাঁর আন্দোলন শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল । অ্যানি ব্যাসান্ত ও তিলক উভয়েই নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিলেন এবং সেজন্যই জনসাধারণ বিশেষত যুবগোষ্ঠী দুই নেতার পতাকা তলে এসে সমবেত হন । হোমরুল আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় ব্রিটিশ শাসকবৃন্দ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন । তাঁরা আন্দোলনকারীদের ওপর যথেচ্ছ দমন পীড়ন ও অত্যাচার চালান । তিলককে গ্রেফতার এবং ব্যাসান্তকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় । শেষ পর্যন্ত প্রবল গণবিক্ষোভের ফলে সরকার শ্রীমতী ব্যাসান্তকে মুক্তি দেন এবং তিলককে কুড়ি হাজার টাকার জামিনে মুক্তি দেবার কথা ঘোষণা করেন । তিলক তা দিতে অস্বীকার করলে তিনি কারান্তরালে প্রেরিত হন ।
হোমরুল লিগ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করতে পারেনি ঠিকই তবে—
(১) এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কংগ্রেসে স্বরাজের দাবি গৃহিত হয় ।
(২) হোমরুল আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই তৃণমূল স্তর থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রবণতা জাগে ।
(৩) এই আন্দোলন জনগণকে সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করেছিল ।
(৪) এই আন্দোলনের পথ ধরেই গান্ধিজির নেতৃত্বে গণআন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিল ।
(৫) এই আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতসচিব মন্টেগু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট ভারতীয়দের প্রতিশ্রুতি দেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে ভারতবাসী যাতে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করতে পারে, ব্রিটিশ সেই নীতিই গ্রহণ করবেন । এই ঘোষণার ফলশ্রুতি হল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন । ভারতসচিব মন্টেগু ও ভাইসরয় চেমসফোর্ডের যৌথ প্রয়াসে এই আইন প্রণয়ন হয় বলে একে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন বলে ।
*****
- 15848 views