জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগ

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 21:45

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগ (The Early Phase of National Congress) :

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক বিশেষ স্তরে জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয় । উনবিংশ শতাব্দী ছিল 'সভাসমিতির যুগ' । ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ নিয়ে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সঙ্গে এ দেশের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয় ।

কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন (The First Session of the Indian National Congress) :

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে ডিসেম্বর বোম্বাই -এ গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসে । ২৮ থেকে ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনদিন ব্যাপী এই অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি তাঁর সভাপতির ভাষণে কংগ্রেসের চারটি প্রধান উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন—

(১) দেশের কল্যাণ সাধনে ব্রতী এরূপ ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করা ।

(২) জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে অন্তরায় এমন সব জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য ও প্রাদেশিক কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথ প্রশস্ত করা ।

(৩) জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যাগুলি সম্পর্কে ভারতের শিক্ষিত সমাজের সুচিন্তিত মতামত লিপিবদ্ধ করা ।

(৪) তাঁদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সেই সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করা এবং পরবর্তী এক বছরে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকলাপ জনস্বার্থে কোন পথে পরিচালিত হওয়া উচিত তা স্থির করা । এই অধিবেশনেই ভারতীয়দের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা ও প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মোট ৭২ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেছিল । তাঁদের বক্তৃতায় ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্যের কথা ঘোষিত হয় ।

কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন (The Second Session of the Indian National Congress) :

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে । দাদাভাই নৌরজি এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন । হিউমের অনুরোধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সদলবলে কংগ্রেসে যোগ দিলে দলটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং দলে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয় । দ্বিতীয় অধিবেশনে আরও কতকগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ভারতীয় জনগণের সীমাহীন দারিদ্রের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় । দ্বিতীয় অধিবেশনে নির্বাচিত সদস্যদের যোগদানে কংগ্রেস রীতিমতো প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থার মর্যাদা পায় ।

কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশন (The Third Session of the Indian National Congress) :

১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশন বসে । এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন বদরুদ্দিন তায়েবজী । প্রচুর উত্সাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ৬০৭ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি এই অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন । কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল ও সেই সঙ্গে এক শ্রেণির জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বাড়ছিল । এঁরা অধিকাংশই ছিলেন বাংলা থেকে আগত প্রতিনিধি । বাংলা থেকে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, বিপিনচন্দ্র পাল দাবি জানান কংগ্রেসকে দু-চারজন নেতার কুক্ষিগত করে রাখা চলবে না ও দলের গণতন্ত্রীকরণের জন্য তাঁরা নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন । তাঁদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত একটি 'বিষয় নির্বাচনী কমিটি' গঠিত হয় এবং কমিটির উপর কংগ্রেসের বাকি অধিবেশনের আলোচ্য সূচি স্থির করার দায়িত্ব অর্পিত হয় । কলকাতায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল সর্বভারতীয় বিষয়গুলি আলোচনায় স্থান পাবে । তার বাইরে গিয়ে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি আসামের চা বাগিচার শ্রমিকদের ওপর মালিকদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিষয়টি অধিবেশনে আলোচনার দাবি জানান ।

কংগ্রেসের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব (The The British Attitude towards Indian National Congress) :

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকলাপ এবং নেতৃবৃন্দের মনোভাব সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার আগাগোড়াই সজাগ ছিলেন । কলকাতায় আহুত দ্বিতীয় অধিবেশনে বাঙালি নেতৃবৃন্দের যোগদানের পর থেকেই তাঁরা এঁদের মনোভাব ও কথাবার্তার ওপর তীক্ষ্ম নজর রেখেছিলেন । ফলে বোম্বাই অধিবেশনে যে সরকারি পর্যবেক্ষক দল উপস্থিত ছিলেন কলকাতায় দ্বিতীয় অধিবেশন থেকেই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় । মাদ্রাজ অধিবেশনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডাফরিন ঘোষণা করেন কংগ্রেস তার প্রতিশ্রুত পথে যাচ্ছে না । হিউমের কথামত কংগ্রেস ইংল্যান্ডের বিরোধী দলের মতো ভূমিকা পালনে ব্যর্থ । বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ভাইসরয় আরও ঘোষণা করেন যে, কংগ্রেস ভারতীয় জনসাধারণের অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দ্রষ্টব্য এক ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধি মাত্র এবং তাঁরা না জেনেশুনে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছেন । 'কংগ্রেস হল বাবু শ্রেণির একটি সংগঠন মাত্র'— একথা বলেও তিনি কংগ্রেসের কৃতিত্বকে হেয় করতে চেয়েছিলেন । অতঃপর কংগ্রেস সম্পর্কে ব্রিটিশের অপছন্দের মনোভাব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে । এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত চতুর্থ অধিবেশন থেকেই ব্রিটিশের কংগ্রেস বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সরকারি বিরোধিতায় উদ্যোক্তারা অধিবেশনের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার মহারাজা লোথাল ক্যাসেল নামক প্রাসাদটি কিনে নেন এবং সেটি কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য ছেড়ে দেন । 

সাম্প্রদায়িক উস্কানি : কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও প্রভাব প্রতিপত্তিতে শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অগ্রগতি রোধ করার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন । কংগ্রেসের নেতৃত্বে যাতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হতে না পারে তার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে শুরু করেন । তাঁদের উস্কানিতেই কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলে জনৈক মুসলমান সদস্য আনুপাতিক হারে মুসলমান সদস্য গ্রহণের সংস্থান রাখার প্রস্তাব করেন । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বেশির ভাগ মুসলমান সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন । 

*****

 

 

 

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা