বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য

Submitted by Nandarani Pramanik on Mon, 07/20/2020 - 23:14

ভূমিকা—" ছয় সেবাদাসী

                        ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি ।"

রূপময়ী বাংলার প্রকৃতি । এই রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন "বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর ।" সুজলা সুফলা বাংলার বাইরে গেলে বোঝা যায় যে, অন্যান্য জায়গা থেকে বাংলা কতখানি আলাদা । প্রকৃতির লীলাভূমি এই বাংলায় একের পর এক ছয় ঋতুর আগমন ঘটে এক এক সাজে ।

গ্রীষ্ম —বাংলার প্রথম ঋতুর আবির্ভাব হয় গ্রীষ্মে । তাই ঋতুর নাম গ্রীষ্ম । বছরের প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাস নিয়ে গ্রীষ্ম । গ্রীষ্মের প্রখর তাপপ্রবাহে মাঠ-ঘাট খাঁ খাঁ করে । এরই মধ্যে বৈশাখের রক্তচক্ষু ম্লান করে উপস্থিত হয় কালবৈশাখী । একদিকে সূর্যের বহ্নিশিখা, অপরদিকে কালবৈশাখীর পৃথিবী কাঁপানো রণদামামা । এমন রুদ্র সুন্দর প্রকৃতির ডালি ভরে ওঠে আম, জাম, কাঁঠালের সরসতায় । জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধার সৌরভে সৌরভিত হয় পল্লীর গৃহকোণ ।

বর্ষা— "ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে / জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে 

            ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা / শ্যামগম্ভীর সরসা ।"

ঋতু পর্যায়ের দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা । আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস নিয়ে বর্ষাকাল । বর্ষা আসে আপন মহিমায়, ঘনঘন বিদ্যুতের চমকে আর অনবরত বারিধারায় আমরা জানতে পারি বর্ষারাণীর আগমন বার্তা । বর্ষার পুতধারায় বাংলার খাল, বিল, নদী,নালা ভরে ওঠে কানায় কানায় । প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনও নেচে ওঠে । বাংলার কৃষকের প্রাণেও জাগে নবীন সুর ও আশা । কেন না বর্ষা ফল ও ফসলের ঋতু, ধান রোপনের ঋতু । বাংলার জলে, স্থলে, বনতলে নবীন কিশলয়ে লাগে প্রাণের দোলা । তারপর পথে পথে কদম্ব কেশরের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে বিদায় নেয় বাঙালীর প্রাণের ঋতু বর্ষা ।

শরৎ— বর্ষা বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আগমন হয় শরৎ । বাংলার ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস নিয়ে শরৎকাল । একে পূজার ঋতুও বলা হয় । প্রকৃতিতে সজো সাজো রব দেখেই বোঝা যায়, শরতের আগমন । নীল আকাশের মাঝে মাঝে পেঁজা ধবধবে সাদা তুলোর মতো মেঘের ভেসে বেড়ানো ।

               "আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা ।

                     নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা ।।"

রাশি রাশি কাশফুলের সমারোহে, শিউলি ফুলে, সরোবরে পদ্ম ফুলের সমারোহে সেজে ওঠে শরৎ । প্রকৃতিতে বেজে ওঠে আগমনীর সুর । বাঙালীর জাতীয় উৎসব -দুর্গোৎসব শারদীয়া এই ঋতুতেই হয় । যার জন্য ধনী-দরিদ্র আপামর বাঙালী মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে । কবির কণ্ঠে শোনা যায়—

         " শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি ।

                 ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি ।।"

হেমন্ত —শরতের আনন্দের রেস কাটতে না কাটতে প্রকৃতিতে হেমন্তের উদয় হয় । কুয়াশার চাদরে মুড়ি আসে হেমন্ত । কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু । ফসল পাকানোর পালা চলে । ফসল তোলা হয় এই সময় । কৃষকের ঘরে ঘরে ফসল কাটার আনন্দের সঙ্গে পালিত হয় নবান্ন উৎসব ।

শীত— হেমন্ত শেষ হলে বাংলার ঋতুরঙ্গে আসে শীতের পালা । পৌষ ও মাঘ দুই মাস নিয়ে শীতঋতু । উত্তরে হিমেল হাওয়া, গাছে গাছে পাতা ঝরে যায় । উত্তরে শীতে গ্রাম বাংলার মানুষ শীতে কাঁপে । কিন্তু শীতকাল আনন্দ উৎসবের দিক থেকেও কম যায় না । রং বেরঙের ডালিয়া, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বাহারে প্রকৃতি সেজে ওঠে আপন ছন্দে । শীতের পার্বণ পৌষ পার্বণ । পিঠে পুলি ও নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করে বাংলার বাতাস । বাঙালীর ভ্যালেন্টাইন ডে সরস্বতী পুজা এই সময় হয় । সরস্বতী পূজা বড়দিনের উৎসবের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় শীত ।

বসন্ত— শীতের শেষে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন । ফাল্গুন ও চৈত্রমাস নিয়ে বসন্ত । নবযৌবনের অগ্রদূত । গাছে গাছে নব কিশলয় আর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বন বনান্তর । বসন্তের দূত কোকিলের কুহুতানে চারিদিক মুখরিত হয় । রঙের উৎসব বসন্ত । বাঙালীর দোল আর সর্বভারতীয় হোলির উৎসব এই সময় হয় । হোলির রঙের সঙ্গে প্রকৃতির রঙে, অর্থাৎ পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে রেঙে ওঠে প্রকৃতি । এইভাবে চৈত্রের শেষে বিদায় নেয় বসন্ত ।

উপসংহার— বাংলার ঋতুরঙ্গশালার এই ছয়টি ঋতু আপন বৈচিত্র্যে চির পুরাতন হয়েও সে চির নতুন । তাই এই ছয় ঋতু আমাদের জীবনে, সাহিত্যে, কাব্যে, শিল্পে, সংগীতে, মিলনে, বিরহে, উৎসবে, মনে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে ।

*****

Comments

Related Items

ছাত্র জীবনে খেলাধূলার প্রয়োজনীয়তা

'ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ' । ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজ হল পড়াশুনা করা । পড়াশুনাকে তপস্যার মতো করেই করা দরকার ।

বিশ্বের ত্রাস মহামারী করোনা

ভুমিকা:- একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার শিখরে বাস করেও মানুষ ভয়ঙ্কর এক মহামারির মোকাবিলা করতে পারেনি । সেই মহামারি হল করোনা । ধনী বা দরিদ্র কোন দেশই করোনা নামক মহামারির কবল থেকে রেহাই পায়নি । করোনা এমনই এক রোগ যা অতি দ্রুত মানুষকে সংক্রমিত করে । এটা নতুন রো

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্প

"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি । / দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী — / মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, / কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু / রয়ে গেল অগোচরে । বিশাল বিশ্বের আয়োজন ; / মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ ।" — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

যুগে যুগে বাংলার বুকে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অন্যতম । ঈশ্বরচন্দ্রের পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, নির্ভীকতা, হৃদয়বত্তা মানবসমাজে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত । হিমালয়ের মতো বিশাল ও উন্নত মনের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর ছিলেন না, করুণার সিন্ধুও ছিলেন ।

রক্তদান — মানবকল্যাণের আর এক নাম

"দেহের একটু রক্ত দিলে যদি বাঁচে একটি প্রাণ, / ধন্য হবে জনন তোমার, মহৎ তোমার দান । "