প্রশ্ন:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কী কী কারণে ইউরোপীয় দেশগুলির গণতন্ত্রের পতন ঘটে ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ আলোচনা কর ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম প্রভৃতি ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলি জয়ী হয় । তখন মনে হয়েছিল যে, ইউরোপীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটবে । যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পরাজিত দেশগুলি, যেমন— জার্মানি ও ইতালিতে গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয় । কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে (ক) গণতন্ত্রের মড়ক, (খ) নবপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির দুর্বলতা, (গ) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব, (ঘ) দুরদর্শী জনপ্রিয় রাষ্ট্র নায়কের অভাব, (ঙ) অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত, (চ) জাতিসংঘের ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপ গণতন্ত্রের পতন ঘটে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ—
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরাট ধ্বংসকার্য শেষ হওয়ার মাত্র ২১ বছরের মধ্যেই বিশ্ববাসী আরও একটি বিধ্বংসী যুদ্ধের মুখোমুখি হয় । বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই কোনো না কোনো ভাবে এই বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ব্যাখ্যাকালে ঐতিহাসিকরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন, যেমন—
(১) ভার্সাই সন্ধির কঠোরতা ও জার্মানির প্রতিশোধ স্পৃহা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত জার্মানির ওপর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেয় । সন্ধির শর্ত সম্পর্কে জার্মান প্রতিনিধিদের মতামত উপেক্ষা করে তাঁদের সন্ধিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল । সেই একতরফা চুক্তিকে জার্মানির জনগণ কোনো দিনই মেনে নেননি । ইতিমধ্যে জার্মানি ভিতরে ভিতরে সামরিক শক্তিকে সুসজ্জিত করে তোলে । জার্মানির জনগণের সেই জনরোষকে কাজে লাগিয়ে তাই মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই অ্যাড ল্ফ্হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি ভার্সাই সন্ধির সমস্ত অপমানজনক চুক্তি ভেঙে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । অর্থাৎ ভার্সাই সন্ধির কঠোরতার মধ্যে আর একটি বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল ।
(২) জাতি সংঘের ব্যর্থতা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান এবং সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য লিগ্ অফ্ নেশনস্ বা জাতি সংঘের প্রতিষ্ঠা হয় । কিন্তু জাতিসংঘের ব্যর্থতার জন্যই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী ও ন্যৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ববাসী আরও একটি ভয়াবহ ও নৃশংস বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হয় । জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণগুলি ছিল—
(ক) সাংগাঠনিক ত্রুটি,
(খ) নিজস্ব সেনাবাহিনীর অভাব,
(গ) বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুপস্থিতি,
(ঘ) নিরস্ত্রীকরণে ব্যর্থতা,
(ঙ) সদস্য রাষ্ট্রের ভিটো প্রয়োগ প্রভৃতি ।
এইভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল দায়িত্ব পালনে লিগ অফ নেশনস ব্যর্থ হয়, যার পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসম্ভাবী হয়ে ওঠে ।
(৩) জার্মানি, ইতালি ও জাপানের উপনিবেশ বিস্তারের আকাঙ্খা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । জার্মানি, ইতালি ও জাপানের ভাগ্যে কোনো উপনিবেশই জোটেনি । জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্যে এই দেশগুলি উপনিবেশ দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করে । এই ভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনে ।
(৪) গণতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলির মতবিরোধের সুযোগে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিস্তার : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় । দুই বৃহৎ গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের এই মতবিরোধ ফ্যাসিবাদী শক্তির বিস্তারকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল ।
*****