ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্বন্ধে (Relation Between the Printed Text and Dissemination of Knowledge) :-
মুদ্রণশিল্পের প্রসার সারা বিশ্বের জ্ঞানচর্চাকে উচ্চশ্রেণীর সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসারিত করে । ভারত তথা বাংলায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ সর্বোপরি গণশিক্ষার প্রসারে ছাপাখানা ও ছাপাবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে মুদ্রিত পুস্তকের একটি ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে । রেভারেন্ড জেমস লঙ -এর মতে, মুদ্রণ ও শিক্ষার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত । বঙ্গদেশে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পূর্বে হাতে লেখা পুঁথিপত্রের সাহায্যে শিক্ষা গ্রহণের কাজ চলত । এইসব পুঁথিপত্রের দাম যথেষ্ট বেশি হওয়ায় সেই সময়ে নিম্নবিত্ত দরিদ্র সমাজে শিক্ষার প্রসার তেমন ঘটেনি । বাংলার শিক্ষাদান সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমিত ছিল । ছাপা বই বাজারে আসার আগে বাংলায় শিক্ষার প্রসার খুবই সীমাবদ্ধ ছিল । উনিশ শতক থেকে বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ হতে শুরু করে । ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর প্রচুর ছাপাবই বাজারে আসে । ছাপা বইপত্র দামে সস্তা হওয়ায় সেগুলি সাধারণ মানুষের হাতে সহজে পৌঁছে যায় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়, ফলে দেশে ব্যাপক শিক্ষাবিস্তার শুরু হয় ।
১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিসে জেসুইট যাজকেরা প্রথম বাংলা হরফে মুদ্রিত ফরাসি ভাষার একটি বই ছাপায় । ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজ পাদরি মনো এল-দা-আসুসুম্পসাঁও পোর্তুগিজ ভাষায় বাংলা-পোর্তুগিজ শব্দকোশ ও ব্যাকরণ রচনা করেন । এ ছাড়া রোমান হরফে বাংলা ভাষায় তিনি 'কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ' রচনা করেন । ভুষণার জমিদার ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান দোম এ্যান্তোনিও-দে-রোজারিও 'ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ' রচনা করেন । ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে জন অ্যানড্রুজ সাহেবের ছাপাখানা থেকে প্রথম বাংলা ভাষায় একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ছাপা হয় । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড কর্তৃক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এই ব্যাকরণ বইটির নাম 'এ গ্রামার অব দা বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ' (A Grammar of the Bengali Language) । বইটির মধ্যে বাংলা হরফে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত আর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল বিদ্যাসুন্দর থেকে উদ্ধৃতিগুলি তুলে ধরা হয় । হুগলিতে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলনের পরে ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় প্রেস স্থাপন করে ও সেই সঙ্গে ইংরেজ ব্যবসায়ীরাও বিদেশ থেকে প্রেস আমদানি করে ছাপার কাজ শুরু করে । ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই কলকাতায় একের পর এক ইংরেজি ভাষার প্রেস গড়ে ওঠে । ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যক্তিগত মালিকানায় জেমস অগাস্টাস হিকি কলকাতায় ছাপাখানা গড়ে তোলেন । এই ছাপাখানা থেকে 'বেঙ্গল গেজেট' বা 'Hicky's Bengal Gazette' নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ১৭৮০ সালের ২৯শে জানুয়ারি থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে । ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় । বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিকির বেঙ্গল গেজেটকে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র বলে মনে করা হয় । কারণ গুলি হল— (i) এটি ছিল ভারতের প্রথম সংবাদপত্র, (ii) এই সংবাদপত্রটি জাতীয় জীবনে স্বাদেশিকতা বোধের প্রসার ঘটিয়েছিল, (iii) এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্র ।
ছাপাখানা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই ছাপা হতে শুরু করে । ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে জোনাথন ডানকান অনুদিত বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ আইনের বই 'মফসসল দেওয়ানি আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানি আদালতের বিচার ও ইনসাফ চলা হইবার কারণ ধারা ও নিয়ম' প্রকাশিত হয় । এই গ্রন্থটিতে আইনের বিভিন্ন দিকগুলির ওপর আলোকপাত করে ।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা স্থাপন করলে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে । ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বইগুলি জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানার উদ্যোগে বাংলায় প্রচুর স্কুলপাঠ্য বই কম দামে পৌঁছায় । মুদ্রণযন্ত্রে বই ছাপার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাতেও গ্রন্থ রচিত হতে থাকে । মৌলিক গ্রন্থের পাশাপাশি অনুবাদ গ্রন্থও প্রকাশিত হয় । শ্রীরামপুর মিশনের প্রেস থেকে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কাশীদাসী মহাভারত প্রথম মুদ্রিত হয় । ফলে বাঙালি সমাজের গরিষ্ঠ অংশ মুদ্রিত আকারে মহাকাব্যের ধারণা উপলব্ধি করে । বাবুরামের সংস্কৃত প্রেস থেকে সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের ওপর একাধিক বই ছাপা হয় । ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে হেমচন্দ্র কোশ ও অমর কোশ এবং ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে অভিধান চিন্তামণি ও গীতগোবিন্দ প্রভৃতি সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা হয় । ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে উয়িলিয়াম কেরি 'ইতিহাসমালা' গ্রন্থ রচনা করেন । এই গ্রন্থ থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা ধরনের গল্প ও তথ্য জানা যায় । উইলিয়াম কেরির সহকর্মী জশুয়া মার্শম্যান ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' ও ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে 'বাঙ্গালার ইতিহাস' রচনা করেন । ইতিহাস আশ্রিত কাহিনি অবলম্বনে রামরাম বসু রচনা করেন রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র । মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচনা করেন বত্রিশ সিংহাসন রাজাবলি গ্রন্থ । এই সমস্ত ছাপা গ্রন্থগুলি থেকে বাংলা গদ্য রীতির বিকাশ শুরু হয় ও সেই সঙ্গে ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞানের প্রসার ও তার সঠিক বিকাশ ঘটতে শুরু করে । পরবর্তীকালে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন ছাপাগ্রন্থগুলি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে প্রভূত সাহায্য করে । কম খরচে ও বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে 'ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি' প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গড়ে ওঠে বহু বিদ্যালয় । গিলখ্রিস্টের হিন্দুস্তানি ছাপাখানা থেকে কলেজের বিদেশি পড়ুয়াদের জন্য উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের বই ছাপানো হয় । ম্যাথু ল্যাম্পসডেনের পারসিয়ান ছাপাখানা থেকে ফারসি ভাষায় প্রকাশিত বই ছাপানো হয় ।
সংস্কৃত কলেজে চাকুরীকালীন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার উভয়ে সংস্কৃতযন্ত্র নামে এক মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন । এই মুদ্রণযন্ত্র থেকে নিজেদের লেখা ও মতামত, পছন্দের পুস্তক মূদ্রণ এবং সেগুলি প্রকাশের মাধ্যমে সর্বাঙ্গীন শিক্ষার বিস্তার করাই ছিল ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের উদ্দেশ্য । ছাপাখানা শিশুশিক্ষার অগ্রগতি ও প্রসার ঘটায়, প্রকাশিত হয় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের 'শিশুশিক্ষা', বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়', রামসুন্দর বসাকের 'বাল্যশিক্ষা' । বাংলার ছাপাখানায় প্রকাশিত হয় পঞ্জিকা, আইন, ধর্ম, নীতিকথা, ইতিহাস, কৃষিকাজ, সংগীত, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ের বই যার ফলে শিক্ষার্থীদের সামনে উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে যেতে থাকে, তারা উচ্চশিক্ষায় উৎসাহ লাভ করে ।
বাংলায় ছাপাখানার প্রসার ঘটলে ছাপাখানার কাজ শুধু বই ছাপার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে মুদ্রণশিল্পের ব্যবসায়িক বাজার গড়ে তোলে এবং ছবি, মানচিত্র, নকশা ইত্যাদিতে পেশাদারিত্বের সূচনা ঘটিয়ে বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় । চিত্রশিল্পী, হরফ নির্মাতাদেরও কদর বাড়ে । এই উদ্দেশ্যে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় 'স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট' গড়ে ওঠে ।
****