১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 01/01/2021 - 11:58

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি (Characteristics of the Revolt of 1857) : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে প্রথম ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং ক্রমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ব্যক্তির নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে । ভারতের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ ১৮৫৭ -র মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত । এই বিদ্রোহ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুন পর্যন্ত চলে । এই মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক ও পন্ডিতদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে । অনেকে মনে করেন মহাবিদ্রোহ ছিল জাতীয় বিদ্রোহ এবং এই বিদ্রোহের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের সম্পর্ক ছিল । আবার এই মতের বিরোধিতা করে অনেকে বলেন মহাবিদ্রোহ কখনোই জাতীয় বিদ্রোহ ছিল না এবং এই বিদ্রোহের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের কোনো সম্পর্কই ছিল না ।

আবুল কালাম আজাদ বলেন ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে জাতীয়তাবাদের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়ে বিচার করলে একে এককথায় জাতীয় আন্দোলন বলা যায় না । এখানে বিদ্রোহীদের দেশপ্রেমে কোনো অভাব ছিল না । তবে সমকালীন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র দেশপ্রেম দিয়ে কোনো বিদ্রোহ ঘটানো সম্ভব ছিল না । দেশপ্রেম যদি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়, তাহলে এই বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলন বলতে তাঁর আপত্তি নেই, যদিও দেশপ্রেমকে জোরদার করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব বা অন্যান্য নেতৃবর্গের বিদ্রোহে যোগদানে দেশপ্রেমের ধারণা কতদূর ছিল তা বিতর্কের বিষয় ।

এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছিল । ভারতের রক্ষণশীল সমাজ কখনোই ব্রিটিশ শাসকদের ভারতশাসন মেনে নিতে পারেননি । মোগল শাসনের অবসানের কারণ হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশদেরকেই দায়ী করে । বিধবাবিবাহ প্রথা প্রচলন, সতীদাহ প্রথা রদ ইত্যাদিতে ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকায় ভারতের রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের একাংশ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল । এই ঐক্যবোধ থেকে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে । সিপাহিরা ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষও এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল বলে অনেকে এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহের স্বীকৃতি দানের পক্ষপাতী ।

সিপাহী বিদ্রোহকে যাঁরা জাতীয় বিদ্রোহের স্বীকৃতি দানের পক্ষপাতী নয়, তাঁদের বক্তব্য হল যে, এই বিদ্রোহের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিকল্পনা ছিল না । ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার জন্য কোনো সংগঠন গড়ে তোলা হয়নি । সিপাহিদের সঙ্গে ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও বিদ্রোহের প্রধান নেতাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না, এমনকি বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী বা নেতার মধ্যে কোনোরকম বোঝাপড়াও ছিল না । নেতারা এবং বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল । তাঁরা কোনো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা ভাবেন নি । কোনো কোনো অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাবের অভাব থাকলেও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বেশকিছু সৈনিক এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করে । আবার অনেকেই ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিল । তাই শুধু জনগণের মধ্যেই নয়, সিপাহিদের মধ্যেও জাতীয়তাবোধের অভাব ছিল ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষ অংশ গ্রহণ না করায় এই  বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় না । দেশীয় রাজাদের মধ্যে সিন্ধিয়া, গায়কোয়াড়, হোলকার, হায়দরাবাদের নিজাম, রাজস্থান, মহীশূর ও ত্রিবাঙ্কুরের রাজারা নিজেদেরকে এই বিদ্রোহ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন । আবার ঝিন্দ ও পাতিয়ালার শিখ দলপতিরা ইংরেজদের সমর্থন করেছিল । পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল । উত্তর ভারতের এক বিস্তৃত অঞ্চলে ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লেও ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে বিশেষত বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে এই বিদ্রোহের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় না । সর্বভারতীয় চরিত্র না থাকায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলন বলা যায় না ।

জাতীয় আন্দোলন বলতে যদি বোঝায় যে, সমাজের প্রতিটি মানুষই এক মনপ্রাণ হয়ে একটি জীবনমরণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাহলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কোনোমতেই জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় না । ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই কারণে বলেছেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয় । সুশোভনচন্দ্র সরকার, ড. মজুমদারের যুক্তির বিপক্ষে বলেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ যদি জাতীয় বিদ্রোহ না হয়, তাহলে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে স্পেনের বা রাশিয়ার যুদ্ধকেও জাতীয় সংগ্রামের স্বীকৃতি দেওয়া যায় না । ইটালির কার্বোনারি আন্দোলনও জাতীয় আন্দোলনের মর্যাদা দাবি করতে পারে না । পক্ষে ও বিপক্ষের মত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নিরপেক্ষভাবে বলা যায় যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা থাকায় একে জাতীয় বিদ্রোহ বলা এক বিতর্কিত বিষয় ।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব :- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায় । দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদ মিত্রের লেখায় মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে ও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় । সে সময়কার ইংরেজি-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি মহাবিদ্রোহকে সমর্থন করেন নি । বিশেষত যে সমস্ত শিক্ষিত বাঙালি শ্রেণি ইংরেজদের অফিস-আদালতে কাজ করে জীবিকা চালাত তাদের মধ্যে মহাবিদ্রোহের প্রতি অনুরাগের অভাব দেখা যায় । মহাবিদ্রোহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হতে চায়নি । তাই এই শ্রেণিকে সিপাহিরা তাদের শত্রু বলে মনে করত । তবে মহাবিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা তাদের চেতনা ফেরায় । তারা বুঝতে পারে, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসন ভারতবাসীর প্রকৃত মঙ্গল করতে পারে না । এই উপলব্ধি পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সুদৃঢ় করে ।

*****

Comments

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?