ভারতসভা (Indian Association) :-
ঊনিশ শতকে ভারতে যেসব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে 'ভারতসভা' বা 'Indian Association' বিশেষ উল্লেখযোগ্য । ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে (বর্তমানে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে 'ভারতসভা' বা 'Indian Association' প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সংগঠনের নামকরণের যুক্তি প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বলেন, ইতালির মহানেতা ম্যাৎসিনির ইয়ং ইটালির আদর্শে সমগ্র ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় 'ভারতসভা' । এই সভায় বেশিরভাগ সদস্যই ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতসভাই ছিল ভারতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন । এই সভার লক্ষ্য ছিল — (i) দেশজুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গড়ে তোলা, (ii) সর্বভারতীয় রাজনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে তোলা, (iii) হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য অক্ষুন্ন রাখা, (iv) রাজনৈতিক আন্দোলনগুলিতে জনগণকে অংশ গ্রহণ করানো ও এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর প্রচেষ্টা করা । এই সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি পূরণ করার জন্য বাংলার মফসসল জুড়ে ভারতসভার প্রায় ১২৪টি শাখা গড়ে ওঠে । সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাংলার বাইরে লখনউ, মিরাট, লাহোর, আমেদাবাদ, মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানে ভারতসভার শাখা গড়ে ওঠে ।
ভারতসভা মধ্যবিত্ত শ্রেণির গণচেতনা প্রতিফলিত করে এবং বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্র হয়ে ওঠে ভারতবাসীর যথার্থ প্রয়োজন মেটায় । অল্পদিনের মধ্যেই ভারত সভা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখায় । ভারতসভা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা, মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইন, ইলবার্ট বিলসহ একাধিক বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে ।
লর্ড লিটন -এর আমলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার বয়সসীমা ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করা হলে, এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা আন্দোলন গড়ে তোলে । সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সারা ভারতে বক্তৃতা করে জনমত সংগঠিত করেন । এই সভার তরফে ইংল্যান্ড ও ভারতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ ও পরীক্ষার্থীর বয়স ২২ করার দাবি তোলা হয় । ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের এই দাবির অনেকটাই মেনে নেয় ও সরকারি সিধান্ত পরিবর্তিত হয় ও বয়সসীমা ২১ বছর বহাল থাকে ।
লর্ড ক্যানিং -এর আমলে প্রবর্তিত অস্ত্র আইনকে লর্ড লিটন কঠোরভাবে বলবৎ করেন । ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন 'মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন' বা 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' পাস করে এবং এই আইনের মাধ্যমে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে । অস্ত্র আইন দ্বারা ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকার নিষিদ্ধ হয় । ভারতসভা এই দুটি কালা আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলে । কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় -এর সভাপতিত্বে কলকাতার টাউন হলে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় । শেষ পর্যন্ত লর্ড রিপন -এর আমলে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইন দুটি প্রত্যাহৃত হয় ।
১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপন -এর আমলে তার আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট একটি বিল তৈরি করেন । এই বিলের মাধ্যমে ইউরোপীয় ও ভারতীয় বিচারকদের সমমর্যাদা ও সমক্ষমতার অধিকার দান করা হয় । ইতিপূর্বে কোনো ভারতীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা জজের ইংরেজদের বিচার করার অধিকার ছিল না । ইলবার্ট বিলে সেই অধিকার দেওয়া হলে ইউরোপীয়রা এর তীব্র বিরোধিতা করে । কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার ব্রানসন -এর নেতৃত্বে ইংরেজরা 'ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠা করে এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে । ইউরোপীয়দের এই আন্দোলনের প্রত্যুত্তরে ১৮৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতসভার পরিচালনায় ইলবার্ট বিল আন্দোলন শুরু হয় । যদিও শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ইউরোপীয়দের দাবি মেনে নিয়ে এই বিলের বেশকিছু ধারা সংশোধন করে । ভারতসভার আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তাদের আন্দোলনের জেরে জনমানসে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে জাতিবৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে ।
ভারতসভার নেতৃবৃন্দের সহায়তায় এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় উদ্যোগে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বা অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে মহাসভা অনুষ্ঠিত হয় । ড. অমলেশ ত্রিপাঠি সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনকে 'জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া' বলে অভিহিত করেছেন । কেন না এই সম্মেলনের প্রেরণায় অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের উদ্যোগে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশনে যোগদান করেন । ফলে জাতীয় কংগ্রেস অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে ।
****