আনন্দমঠ (Anandamath):-
ঊনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলেন । এজন্য উপন্যাসটি 'স্বদেশপ্রেমের গীতা' নামে পরিচিত । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসটি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটি রচনা করেন । ইতিহাসের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসটি স্বদেশপ্রেমের এক জ্বলন্ত নিদর্শন । এই উপন্যাসে সন্তান দলের মুখ দিয়ে উচ্চারিত বন্দে মাতরম ধ্বনি বাংলা তথা সমগ্র ভারতবাসীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আদর্শে উদ্দীপ্ত করে । উপন্যাসটির কয়েকটি বিশিষ্ট চরিত্র হল ভবানন্দ, জীবনানন্দ, কল্যাণী, বীণা, সত্যানন্দ, মহেন্দ্র প্রমুখ ।
এই উপন্যাসটির কাহিনিতে দেখা যায় একদল বাঙালি যুবক মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য এক বৃদ্ধ সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অত্যাচারী নবাবি শাসনের অবসান ঘটানোর শপথ নেয় । এই উদ্দেশ্যে তারা গভীর অরণ্যে আশ্রম তৈরি করে বাস করে সেখানে তারা মাতৃমূর্তি অর্থাৎ দেশজননীর প্রতিষ্ঠা করে । এভাবেই দেশভক্তি উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে ওঠে । যুবক সন্তান দলের ত্যাগ, বৈরাগ্য ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব সমর্পণের আদর্শ পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ।
ওয়াল্টার স্কট রচিত 'ওল্ড মর্টালিটি' উপন্যাসে বর্ণিত বিদ্রোহের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের কাহিনির কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে । দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে 'কভেনান্টার' নামে স্কটল্যান্ডের সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইংল্যান্ডের রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । জন্মভূমিকে মাতৃদেবীর সঙ্গে তুলনা করায় স্বদেশবাসীর অন্তরে দেশাত্মবোধ সঞ্চারিত হয় । 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ সংগীত 'বন্দেমাতরম' পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের 'জাতীয় মন্ত্রে' পরিণত হয় । বিপ্লবীরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে থাকে । বিপ্লবী আন্দোলনের সময় দেখা যায় বিপ্লবীরা একহাতে আনন্দমঠ এবং অন্য হাতে গীতা নিয়ে মাতৃমুক্তি যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে আনন্দমঠের বন্দেমাতরম মন্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় । 'বিপ্লববাদের জননী' ভিকাজি রুস্তম কামা যিনি মাদাম কামা নামে পরিচিত ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পরাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরি করলে সেখানে 'বন্দেমাতরম' মন্ত্রটি স্থান পায় । স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলিতে বন্দেমাতরম মন্ত্র বিপ্লবীদের বীজমন্ত্র হয়ে ওঠে । আনন্দমঠ উপন্যাসে ভারতের জাতীয় সংগীত 'বন্দেমাতারাম' ইংরেজদের 'গড সেব দ্য কিং', ফরাসিদের 'দাস মারসেই-মেইজ', জার্মানদের 'হেইল-ডির সিয়োজারভানজ', ইতালীয়দের 'লা মারসিয়া রিয়েল' প্রভৃতি জাতীয় সংগীতের থেকে এগিয়ে কারণ বন্দেমাতরম -এর মধ্যে এক বৃহৎ জাতির আত্মজাগরণের মন্ত্র লুকিয়ে ছিল, তা অন্য দেশের জাতীয় সংগীতে ছিল না । তাই আনন্দমঠ উপন্যাসকে জাতীয় জাগরণের অন্যতম উৎস বলা হয় ।
****