রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শান্তিনিকেতন ভাবনা এবং বিশ্বভারতীর উদ্যোগ

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 01/21/2021 - 19:58

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শান্তিনিকেতন ভাবনা এবং বিশ্বভারতীর উদ্যোগ — প্রকৃতি মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় (Education in Harmony with Nature) :-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির কঠোর সমালোচনা করলেও তিনি ইংরেজি বা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধী ছিলেন না । ইংরেজিকে বর্জন করার কথা তিনি কখনও চিন্তা করেননি, বরং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন । তিনি বলতেন জ্ঞানের কোনো ভৌগলিক ও জাতিগত পরিচয় নেই । ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা হত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিরোধী ছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে দেখেছেন । তাঁর দৃষ্টিতে "শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন" । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তিনি বলেছেন— "ছেলেদের মানুষ করে তুলবার জন্য যে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না ।" তিনি বলেছেন— "শিক্ষা হবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অঙ্গ, চলবে একসঙ্গে, একতালে একসুরে, সেটা ক্লাস নামধারী খাঁচার জিনিস হবে না ।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'শিক্ষা সমস্যা', 'শিক্ষার হেরফের', স্বদেশি সমাজ', 'তোতাকাহিনি' প্রভৃতি রচনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে তার কঠোর সমালোচনা করেছেন । ভারতের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি থেকে পৃথক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের বিষয়ে তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন । পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ আদর্শ ও চিন্তার প্রতিফলনে যে নতুন শিক্ষানীতির পরিকল্পনা করেন তা বিশ্বভারতীর মাধ্যমে তিনি তাকে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন । তিনি শিক্ষাকে কোনোদিন জীবিকার বাহন হিসেবে দেখেননি । তিনি কেবলমাত্র পুঁথিগত শিক্ষার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে মানুষের মনুষ্যত্ব ও চিত্তের বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেন । 'ছাত্রদের প্রাপ্ত সম্ভাষণ' নামে এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন যে আমাদের আশেপাশে যে জীবন্ত সমাজ, পৃথিবী আছে, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগস্থাপন করা, লোকজীবন জানা, তাদের ভাষা ও জীবনযাত্রার পরিচয় নেওয়ার ইচ্ছা যদি না জন্মায়, তবে তার স্কুলকলেজের শিক্ষা পোশাকি বিদ্যা ছাড়া আর কিছু নয় । মনুষ্যত্ব বিকাশের অঙ্গ হিসেবে তিনি নৃত্যগীত ও কলাবিদ্যাচর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন । কৃষি, সমবায়প্রথা, পল্লী উন্নয়ন, কারুশিল্প, স্বনির্ভরতা প্রভৃতির মাধ্যমে মনের পরিপূর্ণ বিকাশ ছিল তাঁর শিক্ষাদর্শনের মূল কথা । 

শিশুরা সবসময় মুক্ত পরিবেশ পছন্দ করে । শিক্ষা যাতে নীরস ও যান্ত্রিক না হয় সেজন্য তিনি ছাত্রদেরকে চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করার কথা বলেছিলেন । খাঁচায় আবদ্ধ করে তোতাপাখিকে শিক্ষাদান করলে যে অবস্থা হয়, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রদেরও তাই হয়েছিল । আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে শিক্ষাগ্রহণের আনন্দ সংযোজিত হয়েছে । ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় এই ভাষা রপ্ত করতে ছাত্রদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হত । ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায় । তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন । তিনি বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার বিরোধী ছিলেন । যারা ইংরেজীতে দক্ষ নয়, তারা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে লাভ করতে পারে তার জন্য তিনি সুপারিশ করেছিলেন ।

এই শিক্ষানীতির বাস্তব রূপ দিতে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন । মারধর বা কড়া শাসনের জন্য শিশুরা যাতে শিক্ষা গ্রহণে ভীত না হয় এবং পাঠ্যবিষয় কঠিন হলেও ছাত্রেরা যাতে তা আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে, সেই আদর্শ সামনে রেখে ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের নিকটস্থ শান্তিনিকেতন আশ্রমে "ব্রহ্মচর্যাশ্রম" নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন । প্রচলিত বৃত্তিমুখী অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ মনোবিকাশের সুযোগ দেওয়াই ছিল এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য । তাঁর শিক্ষাপদ্ধতির মূল কথা হল প্রাকৃতিক পরিবেশে আনন্দের মধ্যে শিশুদের বড়ো করে তোলা । তপোবন শিক্ষার অন্ধ অনুকরণ না করে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অতীতের আশ্রম শিক্ষার চিরন্তন আদর্শের ভিত্তিতে এই বিদ্যালয় গড়ে ওঠে । তাঁর ভাষায়— "তপোবনের বাহ্য অনুকরণ যাকে বলা যেতে পারে, তা অগ্রাহ্য, কেন-না এখনকার দিনে তা অসঙ্গত, তা মিথ্যে । তার ভিতরকার সত্যটিকে আধুনিক জীবনযাত্রার আধারে প্রতিষ্ঠিত করা চাই ।" তিনি বলতেন— "আশ্রমের শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার শিক্ষা ।" সেখানে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । তিনি দুঃখের সহিত বলেছিলেন — "প্রাচীন ভারতে শিক্ষা পণ্যদ্রব্য ছিল না । এখন যাঁহারা শিক্ষা দেন, তাঁহারা শিক্ষক, তখন যাঁহারা শিক্ষা দিতেন, তাঁহারা গুরু ছিলেন ..... শিক্ষক পাওয়া যায়, গুরু সহজে পাওয়া যায় না ... আশ্রমের কেন্দ্রস্থলে যিনি আছেন তিনি গুরু । তিনি যন্ত্র নন, তিনি মানুষ ।" ঔপনিবেশিক শিক্ষার এক বলিষ্ঠ বিকল্প হিসেবে কবিগুরু আশ্রম জীবনযাপন, প্রাকৃতিক সান্নিধ্য ও উপকরণহীন অনাড়ম্বর সংযম সাধনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন ।

ঔপনিবেশিক শিক্ষার ফসল হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে তা ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না । নালন্দা ও বিক্রমশিলা ছিল ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ । প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আধুনিক বিদ্যার পঠনপাঠনে একটা সমন্বয়সাধন করে তিনি বিশ্বভারতীকে শাশ্বত ভারতীয় আদর্শের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যার মিলনক্ষেত্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ইচ্ছার কথা তিনি নিজের ভাষায় বলে গিয়েছেন— "আমাদের দেশের বিদ্যানিকেতনকে পূর্ব-পশ্চিমের মিলন নিকেতন করে তুলতে হবে, এই আমার অন্তরের কামনা । বিষয় লাভের ক্ষেত্রে মানুষের বিরোধ মেটেনি, সহজে মিটতেও চায়না । সত্যলাভের ক্ষেত্রে মিলনের বাধা নেই ।" ভারতের ক্ষেত্রেও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষায় জাতি, ধর্ম ইত্যাদি বিভেদের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিশ্বভারতী শুধু এক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, এটি ছিল একটি আদর্শ ও বিশ্বমানবতাবাদের প্রতীক । এইরূপ মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে ভারত বা পৃথিবীর অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি । এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একক ও স্বতন্ত্র । জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারক সংস্থা NCERT কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মানোন্নয়নে পাঠ্যপুস্তক লেখা ও পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে যে জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা (NCF, ২০০৫ খ্রি.) নির্মাণ করে তাতে অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে ।

*****

Comments

Related Items

জমিদার সভা (Landholders' Society)

জমিদার সভা (Landholders' Society) :-

উনিশ শতকের প্রথমভাগে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে । এই সময়ে গড়ে উঠা রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল 'জমিদার সভা' । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে উদ্ভূত জমিদার

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (Bangabhasa Prakashika Sabha) :-

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে যেসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' । ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেশন অ্যাক্ট প্রবর্তন করে ব্র

সভা সমিতির যুগ : বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ

সভা সমিতির যুগ : বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ :- (Age of Associations)

ঊনিশ শতকের প্রথম থেকে ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে একের পর এক আদিবাসী ও কৃষক আন্দোলন এবং মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে । ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রসার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবি

মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ)

মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) (Queen's Proclamation) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় । এই যুদ্ধের

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি (Characteristics of the Revolt of 1857) : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে প্রথম ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং ক্রমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ব্যক্তির