Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 01/20/2021 - 10:41

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা (Critique of Colonial Ideas Regarding Education):-

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনাপর্বে বাংলা তথা ভারতের শিক্ষার্থীরা পাঠশালা, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসা থেকে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি -র মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করত । এসব প্রতিষ্ঠানে মূলত ধর্মীয় কাহিনি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষা এবং সাধারণ কিছু বিষয়ের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হত । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিকে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে চায় নি । কারণ (১) তারা মনে করত ভারতীয়দের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ব্রিটিশদের অর্থব্যয়ের কোনো প্রয়োজন নেই । (২) ভারতবর্ষের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করলে তারা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারে । (৩) ভারতীয়রা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলে ভাবিষ্যতে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জেগে উঠতে পারে । ব্রিটিশরা দুটি কারণে এদেশের শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে । প্রথমতঃ তারা বুঝতে পারে প্রশাসনের উচ্চপদে কোম্পানির কর্মচারীরা থাকলেও প্রশাসনের নিম্নস্তর চালানোর জন্য উপযুক্ত লোকবল তাদের নেই । ভারতীয় কর্মচারীদের ওপর তাদের নির্ভর করতেই হবে । ইংরেজ আমলে প্রশাসনের ভাষা হিসেবে প্রচলিত ফারসি ভাষার জায়গায় ইংরেজি ভাষা স্থান দখল করে । কাজেই ভারতীয়দের জীবিকা নির্বাহের জন্য ন্যূনতম ইংরেজি জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । শুধু জ্ঞানার্জন নয়, নিছক কেরানি তৈরির প্রয়োজনে কোম্পানির শাসকরা ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগী হয় । ইংরেজ আমলে শিক্ষাবিস্তার বলতে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারকেই বোঝাত । দ্বিতীয়তঃ ভারতে ইংরেজ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে এদেশের মানুষকেই মনেপ্রাণে ইংরেজ করে তুলতে হবে ।

ব্রিটিশ প্রশাসনের কাজ চালানোর সুবিধার্থে অধস্তন কেরানি তৈরি করা ও পরাধীন জাতিকে বশে রাখাই ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য । শিক্ষার্থীদের শরীর গঠন ও মানসিক বিকাশ বা মেধার উৎকর্ষতা নিয়ে কোনোরকম ভাবনা চিন্তা করা হয়নি । ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষানীতি নির্ধারণ করত এবং সেখানে ভারতীয়দের কোনো ভূমিকা ছিল না । ইংরেজরা নিজের মতো করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলেছিল । বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ ছিল ডিগ্রি প্রদান করা, যে ডিগ্রি ছিল চাকরি পাওয়ার মাপকাঠি । 

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে গিয়ে ব্রিটিশরাও অবগত ছিল যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা বাড়বে, যা ব্রিটিশ শাসনের অস্তিত্বের পক্ষে আদৌ কাম্য নয় । তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে তাদের পক্ষে এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না । ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার হয় । আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব ও ম্যাৎসিনি গ্যারিবল্ডির আত্মোৎসর্গের কথা তারা পাশ্চত্য শিক্ষার মাধ্যমেই জানতে পেরেছিল । পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শনের সংস্পর্শে তাদের মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় । উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির কঠোর সমালোচনা করলেও তিনি ইংরেজি বা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধী ছিলেন না । ইংরেজিকে বর্জন করার কথা তিনি কখনও চিন্তা করেননি, বরং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন । তিনি বলতেন জ্ঞানের কোনো ভৌগলিক ও জাতিগত পরিচয় নেই । ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা হত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিরোধী ছিলেন । তাঁর স্কুলজীবন খুব একটা সুখকর হয়নি এবং তিনি তার সঙ্গে মানিয়ে নিতেও পারেননি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে দেখেছেন । তাঁর দৃষ্টিতে "শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন" । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তিনি বলেছেন— "ছেলেদের মানুষ করে তুলবার জন্য যে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না ।" তিনি বলেছেন— "শিক্ষা হবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অঙ্গ, চলবে একসঙ্গে, একতালে একসুরে, সেটা ক্লাস নামধারী খাঁচার জিনিস হবে না ।"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'শিক্ষা সমস্যা', 'শিক্ষার হেরফের', স্বদেশি সমাজ', 'তোতাকাহিনি' প্রভৃতি রচনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে তার কঠোর সমালোচনা করেছেন । ভারতের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি থেকে পৃথক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের বিষয়ে তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন । পরবর্তীকালে তিনি নিজ উদ্যোগে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন । 

****

Comments

Related Items

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

প্রশ্ন : 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন : হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

প্রশ্ন : উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?