নদীর নিম্নগতি : নদীর অবক্ষেপণের ফলে সৃষ্ট ভুমিরূপ : নদী মধ্যপ্রবাহ থেকে মোহনার দিকে যতই অগ্রসর হতে থাকে, ততই নদীর স্রোতের বেগ কমতে থাকে । স্রোতের বেগ কমে যাওয়ায় শিলাচূর্ণ, নুড়ি, কাদা, পলি, বালি, প্রভৃতি নদী গর্ভে ও নদীর দুই তীরে জমা হতে থাকে । ফলে নানা রকম ভূমিরূপ গড়ে ওঠে ।
প্লাবন ভূমি (Flood Plain) : নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, প্লাবন ভূমি হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ ।
(১) নদীর মধ্য ও নিম্নগতিতে সমভূমি অঞ্চলে নদীর ঢাল ক্রমশ কমতে থাকায় নদীর সঞ্চয় কাজ ক্রমেই বাড়তে থাকে । নদী বাহিত নুড়ি, কাদা, পলি প্রভৃতি জমে নদীগর্ভ ভরাট ও অগভীর হয়ে যায় ।
(২) বর্ষাকালে নদীর প্রবাহপথের এই অংশে নদীর জল হঠাৎ বেড়ে গেলে নদী উপত্যকায় প্লাবন বা বন্যা হয় ।
(৩) প্লাবনের পর নদীর জল নেমে গেলেও নদীর উঁচু পাড় স্বাভাভিক বাঁধের মতো অবস্থান করায় নীচু সমতলভূমির জল বেরোতে পারে না, ফলে তারা প্লাবিত হয়েই থাকে ।
(৪) নদীর প্লাবনের জলে থাকা পলি নদী উপত্যকার নিম্ন অংশে থিতিয়ে পড়ে ও সঞ্চিত হয় । প্রায় প্রতি বছর এই অঞ্চলে নতুন পলি সঞ্চয় ঘটে ।
(৫) এইভাবে নদী উপত্যকার নিম্ন অংশে পলি সঞ্চয়ের ফলে যে ভুমিরুপের সৃষ্টি হয় তাকে প্লাবনভূমি বলে ।
(৬) নদীবাহিত পলি অনেকদিন ধরে নদীর দু’পাশে সঞ্চিত হলে পলিগঠিত যে সমতল ভূ-ভাগের সৃষ্টি হয় তাকে পলি সমভূমি বলে ।
উদাহরণ: উত্তর প্রদেশের হরিদ্বার থেকে বিহারের রাজমহল পর্যন্ত নানান স্থানে গঙ্গার গতিপথের দু'পাশে প্লাবনভূমি ও স্বাবাভিক বাঁধ দেখা যায় । মিশরের নীল নদের গতিপথে প্রথমে প্রথমে স্বাভাবিক বাঁধ এবং পরে বিস্তৃত প্লাবনভূমি দেখা যায় ।
ব-দ্বীপ (Delta) : নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ব-দ্বীপ হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । নদী যেখানে সমুদ্রে এসে পড়ে তাকে নদীর মোহানা বলে । ব-দ্বীপ হল নদীর মোহানায় মাত্রাহীন বাংলা 'ব' -অক্ষরের এর মত ত্রিকোণাকার এক রকম দ্বীপ (∆) । মোহানার কাছে নিম্নগতিতে নদীর গতিপথের ঢাল একেবারে কমে যাওয়ায় নদীতে জলপ্রবাহের গতিবেগ খুব একটা থাকে না । মোহানার কাছে সাগরের জলে স্রোত কম থাকলে নদীগর্ভ, হ্রদ বা সাগর সঙ্গম নদীবাহিত পলি, নুড়ি, কাঁকর, কাদা, বালি প্রভৃতি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় নতুন ত্রিকোণাকার ভূভাগ বা দ্বীপের সৃষ্টি হয় । দ্বীপের চারদিকে থাকে জল । নদী তখন সেই দ্বীপের দু-দিক দিয়ে বয়ে চলে । দ্বীপকে দেখতে গ্রিক অক্ষর ডেল্টা '∆' -এর মতো হলেও বাংলা অক্ষর মাত্রাহীন 'ব'-এর সঙ্গে তার কিছুটা সাদৃশ্য থাকায় তাকে ব-দ্বীপ বলা হয় । পৃথিবীর বেশিরভাগ ব-দ্বীপই গ্রিক অক্ষর ডেল্টার মতো দেখতে হলেও, কোনো কোনো ব-দ্বীপ বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে, যেমন, ভারতে কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী-মিসিসিপি নদীর বদ্বীপ অনেকটা পাখির পায়ার মতো দেখতে ।
সাধারণত তিন ধরনের বদ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়, যেমন:-
(১) ত্রিকোণ আকৃতির ব-দ্বীপ —যেমন:- গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ;
(২) হ্রদ ব-দ্বীপ (হ্রদের ওপর গড়ে ওঠা বদ্বীপ) :— যেমন:- কাস্পিয়ান সাগরে এই ধরনের বদ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়;
(৩) সমুদ্র ব-দ্বীপ (সমুদ্রের ওপর যে বদ্বীপ সৃষ্টি হয়) — যেমন:- সুন্দরবন বদ্বীপ ।
ব-দ্বীপ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ:- নদীতে ব-দ্বীপ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশগুলি হল—
(i) মোহনার কাছে নদীর স্রোতের বেগ কম হওয়া দরকার ।
(ii) নদী তার মোহনার যে অংশে সাগর, উপসাগর, হ্রদে এসে মেশে সেখানকার গভীরতা হওয়া দরকার ।
(iii) নদীর জলে অবক্ষেপণযোগ্য বা সঞ্চয়যোগ্য পলির পরিমাণ বেশি হতে হবে ।
(iv) নদীবাহিত পলি দ্রুত অধঃক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য নদীর মোহনামুখে সমুদ্র জলের লবণত্ব বেশি হওয়ার প্রয়োজন ।
(v) নদী মোহনায় সঞ্চয়ের হার সমুদ্রস্রোতের অপসারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হওয়ার জন্য নদীর মোহনামুখে জোয়ার-ভাটার আধিক্য কম হওয়া প্রয়োজন ।
(vi) নদী মোহনায় প্রচুর পলি সরবরাহের জন্য নদী অববাহিকার আয়তন বেশি হওয়া দরকার । এছাড়া উন্মুক্ত সমুদ্রের তুলনায় স্থলবেষ্টিত সমুদ্রে নদী পতিত হলে ব-দ্বীপ গঠনের পক্ষে সহায়ক হয় ।
*****
- 5416 views