শেরশাহের উত্থান ও রাজত্ব (Rise of Sher Shah)
শেরশাহ (Sher Shah) : মধ্যযুগে ভারতের ইতিহাসে আফগান নেতা শের খাঁ এক বিরল ব্যক্তিত্ব । শের খাঁ তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেন যে, জন্ম দৈবের অধীন হলেও ভাগ্য নিজের হাতে গড়ে নেওয়া যায় । শূরবংশীয় আফগান শাসক শের খাঁ নিজ গুণে ও আপন প্রতিভায় মধ্যযুগে ভারত ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন । তিনি মোঘল শাসক হুমায়ুনের পতন ঘটিয়ে ভারতে আফগান শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন ।
(ক) পূর্ব জীবন : শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ । তিনি সম্ভবত ১৪৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা হাসান ছিলেন সাসারামের জায়গিরদার । ফরিদের বাল্যজীবন সুখের ছিল না । বিমাতার কোপে পড়ে তিনি সাসারাম ছাড়তে বাধ্য হন । পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাসারামের জায়গিরদার রূপে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । ১৫২২ সালে তিনি বিহারের শাসন কর্তার অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন । এই সময়ে তিনি সহস্তে তিনি একটি বাঘ মেরে শের খান উপাধি পান । কিন্তু তাঁর শত্রুরা তাকে সাসারাম ছাড়তে বাধ্য করেন । তখন তিনি বাবরের অধীনে চাকরি করেন । বাবরই তাঁকে সাসারাম ফিরিয়ে দেন ।
(খ) ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজ্য বিস্তার : এরপর শের খান দ্রুত গতিতে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করেন । বিহারের শাসন কর্তা জালাল খান নামে মাত্র বিহারের অধীশ্বর ছিলেন । আসল ক্ষমতা ছিল তাঁর অবিভাবক শের খানের হাতে । চুনার দুর্গ অধীকার করে শের খান আরও ক্ষমতা বৃদ্ধি করলে জালাল খান উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন । তিনি বাংলার সুলতান মামুদ শাহের সঙ্গে মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়ে শের খানকে বাধা দিতে চেষ্টা করেন । কিন্তু শের খান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরজগড় বা কিউলের যুদ্ধে তাঁদের পরাস্ত করে বিহারে নিজের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন । এরপর থেকে শের খানের অগ্রগতি ছিল অব্যাহত । হুমায়ুন যখন গুজরাটে বাহাদুর শাহের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তিনি বাংলা রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন । হুমায়ুন কিন্তু গুজরাট ও মালয় থেকে ফিরে তাঁকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে আগ্রায় অযথা সময় কাটাতে থাকেন । সেই সুযোগে শের খান আবার গৌড় আক্রমণ করেন । তখন হুমায়ুন অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন । কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে চুনার দুর্গ আক্রমণ করে দখল করেন এবং অযথা সময় নষ্ট করে শের খানকে বাংলার উপর পুরোপুরি প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ করে দেন । এরপর শের খান রোটাস দুর্গ দখল করেন । হুমায়ুন তখন বাংলার দিকে অগ্রসর হয়ে গৌড় অধিকার করেন । শের খান হুমায়ুনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে বিহার ও জৌনপুর দখল করে কনৌজ অগ্রসর হন । এই অবস্থায় হুমায়ুন বাংলা পরিত্যাগ করে আগ্রা অভিমুখে রওনা হলে শের খান ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের কাছে চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন । এর ফলে শের খান কার্যত কনৌজ থেকে আসাম ও হিমালয় থেকে ঝাড়খণ্ড ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিরাট এলাকার অধীশ্বর হন । এরপর তিনি শেরশাহ উপাধি গ্রহণ করেন । হুমায়ুন আবার শেরশাহের সঙ্গে ১৫৪০ সালে কনৌজ বা বিল্বগ্রামের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । কিন্তু এই যুদ্ধে হুমায়ুন আবার পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে তিনি পরবর্তী ১৫ বছর ভবঘুরের জীবন যাপন করতে বাধ্য হন । অতঃপর শেরশাহ পাঞ্জাব ও মালয় দখল করেন । রাজপুতদের পরাজিত করে তিনি রাইসিন দুর্গও দখল করেন । ইতিমধ্যে পাঞ্জাবের শাসন কর্তা সিন্ধু ও মুলতান জয় করেন । মারওয়ারের রাজপুত রাজা মালদেব তাঁর কাছে পরাজিত হন । এরপর আজমির থেকে আবু পর্যন্ত সমগ্র এলাকা তাঁর করতলগত হয় । অবশেষে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করার সময় এক বিস্ফোরণের ফলে শেরশাহ মৃত্যুমুখে পতিত হন ।
(গ) শের শাহের শাসন ও রাজস্ব বাবস্থা (Sher Shah's Administrative System and Land-revenue policy) : শেরশাহের রাজত্বকাল মাত্র ৫ বছর স্থায়ী হলেও শাসক হিসাবে তিনি অক্ষয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন । অনেকের মতে বিজেতা অপেক্ষা দক্ষ শাসক হিসাবেই শেরশাহের রাজত্বকাল অধিক গুরুত্বপূর্ণ । ঐতিহাসিক কিনের মতে কোন সরকারই, এমনকি ব্রিটিশ সরকারও শের শাহের মতো শাসন কার্যে বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেন নি । ভিনসেন্ট স্মিথ, ডঃ কানুনগো, ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণও শের শাহের শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । শের শাহের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে চিরাচরিত ভারতীয় শাসনের— তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক না কেন, বৈশিষ্ট্যও যেমন দেখা যায়, তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন ।
(১) শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য : শেরশাহের শাসনব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা । কিন্তু সমস্ত ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভুত থাকলেও তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না । প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল । শাসনের সুবিধার্থে তিনি সমস্ত রাজ্য ৪৭টি সরকারে ও প্রতিটি সরকার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল । শাসন কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তরে ছিল গ্রাম । সরকারের শাসনভার ছিল শিকদার-ই-শিকদারানের ওপর । প্রত্যেক পরগণায় একজন আমিন, শিকদার, একজন কোষাধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষক হিসাবে একজন হিন্দু ও একজন ফার্সি কর্মচারী থাকতেন । একজন মুনসিফ–ই–মুনসিফান পরগণার কর্মচারীদের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করতেন । সরকারি কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থা ছিল ।
(২) ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা (Land-revenue policy) : শেরশাহের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংস্কার হল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা । ভুমি রাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষকের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন । তাঁর নিজের ভাষায় বলি— “আমি যদি কৃষকদের অত্যাচার করি, তাহলে তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে এবং সমস্ত দেশ জনশূন্য ও ধ্বংস হয়ে যাবে ।" প্রতিটি জমি যথাযত জরিপ করার পর খাজনা নির্ধারণ করা হত এবং তা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নগদে বা শস্যে আদায় করা হত । রাজস্বের হার ছিল উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ । রাজস্ব আদায়ের জন্য আমিন, মুকাদ্দম, পাটোয়ারী কানুনগো প্রভৃতি কর্মচারীর সাহায্য নেওয়া হত । রাজস্ব আদায়ে কড়াকড়ি ছিল । কিন্তু কোনো কারণে শস্যের ক্ষতি হলে কর ছাড়ের ব্যবস্থাও ছিল । সম্ভবত কৃষি ঋণের ব্যবস্থাও ছিল । জমিতে কৃষকদের অধিকারের স্বীকৃতি স্বরূপ কবুলিয়ত বা পাট্টার ব্যবস্থা ছিল । শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থার মূল লক্ষ ছিল সরকারের আর্থিক স্বাচ্ছল্য বিধানের সঙ্গে সঙ্গে প্রজার স্বার্থ রক্ষা করা ।
(৩) আর্থিক সংস্কার (Economic Reforms) : রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের দিকেও শের শাহ লক্ষ রেখেছিলেন । তিনি মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করেন ও একটি বলিষ্ঠ শুল্কনীতি গ্রহণ করেন । পরিবহণের উন্নতির জন্য তিনি জি টি রোড সহ কয়েকটি বড়ো বড়ো রাস্তা নির্মাণ করেন । যাত্রীদের সুবিধার্থে রাস্তার ধারে ধারে বৃক্ষরোপণ করা হয় ও সরাইখানা নির্মাণ করা হয় । এই সরাইখানাগুলি আবার ডাকঘর ও সংবাদ আদান-প্রদানের কাজও করত ।
(৪) পুলিশ, বিচার ও সামরিক বিভাগ : রাজ্যে সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা রাখার জন্য পুলিশি ব্যবস্থাকে সংস্কার করা হয় । গ্রামে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ছিল গ্রাম প্রধানের হাতে । বিচারকার্যে ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ করা হত না । পরগণায় বিচারের দায়িত্ব পালন করতেন আমিন, কাজী ও মির-ই-অদল । রাজধানীতে প্রধান কাজি বিচারকার্য সম্পাদন করতেন । বিচারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল স্বয়ং সম্রাটের হাতে । সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি আলাউদ্দিনের পথ অনুসরণ করেন । তিনি একটি নিয়মিত বিরাট সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন । প্রতিটি সৈনিক তাঁর প্রতি অনুগত ছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষা করা হত । কোন প্রকার দুর্নীতি সহ্য করা হত না ।
(ঘ) শেরশাহের কৃতিত্ব : মধ্যযুগের ইতিহাসে শেরশাহ নিঃসন্দেহে একজন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য শাসক । সামান্য একজন জায়গিরদারের পুত্র হয়েও তিনি যেভাবে নিজ প্রতিভাবলে নবজাত মুঘল সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটিয়ে পাঠানদের পুনরাভ্যুত্থানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে । তাঁর সামরিক প্রতিভা উল্লেখযোগ্য হলেও ভারতের ইতিহাসে আমরা তাঁর থেকেও দক্ষ ও শক্তিশালী বীরের নাম হয়ত করতে পারি । কিন্তু আকবরের আগে মধ্যযুগের কোনো সুলতানই শাসক হিসাবে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না । বিশেষত যেভাবে তিনি স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে প্রজা বাৎসল্যের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, তার নজির নেই । পরবর্তী যুগে একমাত্র আকবরই তাঁর কৃতিত্বকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ভুললে চলবে না যে, শেরশাহের রাজত্বের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫ বছর এবং শেরশাহের শাসন নীতির অনেক কিছুই আকবর গ্রহণ করেছিলেন । শেরশাহের রাজনীতির প্রশংসা ঐতিহাসিক মাত্রেই করতে বাধ্য হয়েছেন । নির্মাতা ও শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে সাসারামে নির্মিত তাঁর সমাধি আজও বিদ্যমান । সবশেষে শেরশাহ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন । তাঁর সেনাপতি ব্রহ্মজিৎ গৌড় ছিলেন একজন হিন্দু । তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার যে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, তা মধ্যযুগের ইতিহাসে অতুলনীয় ।
*****
- 16959 views