মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা - বাবর (Founder of Mughal Rule : Babur) :
ভারতে রাজ্য স্থাপন পরিকল্পনা সফল করতে বাবরকে একের পর এক নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে হয় । তিনটি প্রধান যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করার পর বাবরের স্বপ্ন সফল হয় । এই তিনটি যুদ্ধ হল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ ও ঘর্ঘরা যুদ্ধ ।
(ক) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (The first battle of Panipat) : বাবরের ভারত আক্রমণের প্রথম সুযোগ আসে যখন ইব্রাহিম লোদির বিক্ষুব্ধ একটি গোষ্ঠী ইব্রাহিম লোদিকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে বাবরকে আমন্ত্রণ জানান । এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাবর প্রথমে লাহোর অধিকার করেন । এরপর তিনি পাঞ্জাব অধিকার করে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১শে এপ্রিল দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । এই যুদ্ধে বাবরের সেনাবাহিনীর তুলনায় ইব্রাহিম লোদির বাহিনী অনেক বড় হলেও ইব্রাহিম লোদি এই যুদ্ধে পরাস্ত হন । বাবরের সামরিক দক্ষতা ও শৌর্যবীর্যের প্রমাণ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ । কিন্তু এই যুদ্ধে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর দ্বারা বাবরের ভারত বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি ।
(খ) খানুয়ার যুদ্ধ (Battle of Khanua) : আফগান সামরিক নেতারা ও রাজপুতবীর মহারানা সঙ্গ (রাণা সংগ্রাম সিংহ) ছিলেন বাবরের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রধান অন্তরায় । পানিপথের যুদ্ধের পর রানা সঙ্গের সাথে বাবরের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য । রানা সঙ্গ ইব্রাহিম লোদীর চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিলেন । কিছু কিছু আফগান দলপতি তাঁর সঙ্গে যোগ দেন । এই বিপদের দিনেও কিন্তু সমস্ত আফগান দলপতি তাঁর সঙ্গে হাত মেলান নি । ১৫২৭ সালে খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের চরম পরাজয় ঘটে । খানুয়ার যুদ্ধ পানিপথের যুদ্ধের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এই রাজপুতরা । সুতরাং তাদের পরাজয়ের ফলে বাবরের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায় । তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয় । ইতিহাসবিদ রশব্রুক উইলিয়ামস মনে করেন যে, বাবর খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভ না করলে তাঁর পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ সম্পূর্ণ নিষ্ফল হত ।
(গ) ঘর্ঘরার যুদ্ধ (Battle of Ghaghra) : বাবর কনৌজ, বারাণসী ও এলাহাবাদ অধিকার করে বিহারের সীমান্তে উপস্থিত হন । এরপর বাবর আফগান দলপতিদের দমন করতে মনস্থ করেন । বাংলা ও বিহারের আফগান দলপতিদের শায়েস্তা করতে তিনি ঘর্ঘরা ও গঙ্গানদীর সঙ্গমের কাছে একটি প্রান্তরে মিলিত হন । এই অবস্থায় বিহারের শের খাঁ, জৌনপুরের মামুদ লোদি ও বাংলার নসরৎ শাহ অন্যান্য আফগান শাসকদের ঐক্যবদ্ধ করে বাবরের মুখোমুখি হন । বিহারের ঘর্ঘরা বা গোগরা নদীর তীরে বাবরের আক্রমণে আফগান শক্তি বিপর্যস্ত হয় । এই যুদ্ধ ঘর্ঘরার যুদ্ধ নামে পরিচিত । ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে মামুদ লোদির বাহিনী পরাস্ত হয় মামুদ লোদি পালিয়ে যান এবং বহু আফগান নেতা ও বাংলার শাসক নসরৎ শাহ বাবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন । ঘর্ঘরার যুদ্ধে আফগানদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে বাবর উত্তর ভারতের বিস্তৃত এলাকা দখল করেন । তাঁর সাম্রাজ্য অক্ষ নদী থেকে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত ও হিমালয় পর্বত থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । অবশ্য এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় তাঁর কর্তৃত্বের বন্ধন ছিল খুব শিথিল । বাবর তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘ দিন ভোগ করতে পারেনি । এমনকি এই নব প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো শাসন ব্যবস্থাও তিনি চালু করতে পারেন নি । ঘর্ঘরার যুদ্ধের পরের বছর অর্থাৎ ১৫৩০ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে বাবরের মৃত্যু হয় ।
(ঘ) কৃতিত্ব ও মূল্যায়ন : আধুনিক ও সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরা বাবরকে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন । ভিনসেন্ট স্মিথ, হ্যাভেল, রসব্রুক উইলিয়ামস, ডেনিসন রস প্রমুখ ঐতিহাসিকরা উচ্ছ্বসিত ভাষায় তাঁর প্রশংসা করেছেন । বাবরের সামরিক প্রতিভা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, বিদ্যা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ প্রভৃতি তাঁর চরিত্রের দিকগুলি প্রশংসা না করে উপায় নেই । এ কথা স্বীকার্য যে তিনি ভারতের ইতিহাসে কেবলমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেই স্মরণীয় হয়ে আছেন । শাসনতান্ত্রিক প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ তিনি বিশেষ পান নি । তাই বলা হয় তিনি যা করেছেন, তার চেয়ে তিনি যা করে যেতে পারেন নি, তার গুরুত্ব অধিক । অবশ্য যেটুকু সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, তা থেকে তাঁর শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার পরিচয় আমরা পাই না । কিন্তু চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙের বংশধর হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে লুন্ঠনরাজ ও ধ্বংসের পরিবর্তে একটি সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসনীয় । লেনপুন যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, বাবর ছিলেন ভারত ও মধ্য এশিয়ার সংযোগকারী; সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও লুণ্ঠনকারী দস্যুদের মধ্যবর্তী তাঁর স্থান । তিনি ছিলেন তৈমুর ও আকবরের মধ্যবিন্দু ।
বিজেতা হিসাবে বাবরের নাম ভারতের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে । সুদুর তুর্কিস্তান থেকে এসে নিজের প্রতিভা বলে তিনি ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । বাবরের চরিত্রে অসাধারন সামরিক প্রতিভা, ধৈর্য, স্থৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল । একদিকে তাঁর মানসিক বল, গভীর আত্মপ্রত্যয় ও অসাধারণ রণ নৈপুণ্য এবং অপরদিকে তাঁর সাহিত্যানুরাগ ও তুর্কি, ফার্সি ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ইতিহাসের পাঠকদের মনে এক গভীর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ।
(ঙ) বাবরের আত্মকথা : বাবরের আত্মকথা “তুজুক-ই-বাবরি” বা “বাবর নামা” তুর্কি ভাষায় লেখা । বইটি পড়লে জানা যায় বাবর ছিলেন ‘প্রকৃত প্রেমী’ । ভারতের বিভিন্ন গাছ, ফুল, ফল, পশু-পাখির বর্ণনা তিনি রেখে গেছেন । বইটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি নিজের দোষ ত্রুটি অত্যন্ত সততার সঙ্গে লিখে গেছেন । সহজ সরল ভাষায় সমসাময়িক কাল, স্থান ও পাত্রের বিবরণ তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । অসম সাহসী যোদ্ধার মধ্যে যে একটি কবি মন লুকিয়ে ছিল, তা এই বইখানি না পড়লে বোঝা যায় না ।
*****
- 13001 views