ইলতুৎমিস (Iltutmish)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 05/07/2012 - 11:31

ইলতুৎমিস (Iltutmish) :

দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইলতুৎমিস । তিনি ১২১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । কুতুবউদ্দিন তাঁকে ক্রীতদাস হিসাবে ক্রয় করেন । পরে তাঁর প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বদাউনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ও নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয় । কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আরাম শাহ ১২১০ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে দিল্লির সুলতান ঘোষণা করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । কিন্তু তার অপদার্থতা লক্ষ্য করে দিল্লির আমির-ওমরাহগণ ইলতুৎমিসকে দিল্লির সিংহাসন দখল করতে আহ্বান জানান । এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ইলতুৎমিস আরাম শাহকে পরাজিত ও নিহত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন । সিংহাসনে আরোহণ করেই ইলতুৎমিস অসাধারণ ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে কয়েকটি জটিল সমস্যার সমাধান করেন । দিল্লির সিংহাসনে বসার পরে পরেই নাসিরউদ্দিন কুবাচা সিন্ধুতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । গজনির শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইলদিজ -ও ভারতে প্রাধান্য বিস্তারে উৎসুক ছিলেন । বাংলার শাসক আলি মর্দান দিল্লির বশ্যতা অস্বীকার করেন । হিন্দু রাজারাও তাদের হৃত গৌরব উদ্ধারে বদ্ধপরিকর ছিলেন । গোয়ালিয়র ও রণথম্বোর দিল্লির হস্তচ্যুত হয় । এমনকি দিল্লির কিছু আমির-ওমরাহ তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেন । এরপর তিনি মান্দোর ও মালব রাজ্যের কিছু অংশ ভিলসা ও উজ্জয়নী অধিকার করে নেন । কিছুদিনের মধ্যেই ইলতুৎমিসকে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চিঙ্গিজ খাঁর আক্রমনের সম্মুখীন হতে হয় । কিন্তু সৌভাগ্যবশত চিঙ্গিজ খাঁ পাঞ্জাব বিদ্ধস্ত করার পর আর বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে ভারত ছেড়ে চলে যান । যার ফলে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য দারুন এক সংকট থেকে রক্ষা পায় ।

(ক) রাজ্যবিস্তার নীতি : ইলতুৎমিস এই প্রতিকূল পরিস্থিতি সাফল্যের সহিত মোকাবিলা করেন । প্রথমেই তিনি দিল্লির আমির-ওমরাহদের দমন করে নিজ সিংহাসন সুরক্ষিত করেন ও বদাউন, অযোধ্যা, বারাণসী ও শিবালিকে নিজ কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন । এরপর তিনি তাজউদ্দিন ইলদিজকে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে লাহোর থেকে বিতাড়িত করেন । পরে নাসিরউদ্দিন কুবাচা সিন্ধুনদে জলমগ্ন হয়ে মারা যান । ইলতুৎমিস সিন্ধু অধিকার করেন । এরপর রণথম্বোর পুনরাধিকার করে তিনি বাংলার খলজি মালিকদের দমন করেন । গোয়ালিয়রও তার অধিকারে আসে । তিনি মালয় অভিযান করে ভিলসা দুর্গ অধিকার করেন ও উজ্জয়িনী দখল করে তা ধ্বংস করেন । এইভাবে তিনি যখন নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তখন ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফা তাঁকে রাজমর্যাদায় ভূষিত করেন । এর ফলে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ও ভারতের ওপর তাঁর আধিপত্য বৈধ বলে স্বীকৃতি লাভ করে । সুতরাং ঘটনাটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না ।

(খ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি : ইলতুৎমিসকে কেবলমাত্র আভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি । তাঁর আমলে চিঙ্গিস খানের ভারত আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয় । মোঙ্গল নেতা চিঙ্গিস খান মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া জয় করে খিবার শাসক জালালউদ্দিন মঙ্গবার্নির পশ্চাদ্ধাবন করলে তিনি পাঞ্জাবে পালিয়ে ইলতুৎমিসের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করেন । ইলতুৎমিস বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে এই আবেদন অগ্রাহ্য করেন । ফলে মঙ্গবার্নি ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ও চিঙ্গিস খানের অনিবার্য আক্রমণ থেকে ভারত রক্ষা পায় । ইলতুৎমিস অবশ্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করার কোনো ব্যবস্থা করে যান নি । ফলে ভবিষ্যতে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে ।

(গ) শাসক হিসাবে ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব :

(১) সুদক্ষ যোদ্ধা ও কূটনীতিজ্ঞ ইলতুৎমিসই ভারতে সর্বপ্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের একটি সুপরিকল্পিত রাজধানী, সুসংহত সরকার ও শাসক গোষ্ঠির প্রতিষ্ঠা করে যান ।

(২) দিল্লির সুলতানির বিপদের দিনে শুধু যে তিনি রাজত্ব রক্ষা করতে পেরেছিলেন তাই নয়, দিল্লি সুলতানির শক্তি বৃদ্ধি করতেও সক্ষম হন । নিঃসন্দেহে প্রথম যুগের সুলতানদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ও যোগ্য শাসক ছিলেন । এই সব কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে বাগদাদের সুলতানের কাছ থেকে তিনি 'সুলতান-ই-আজম' উপাধি পান । তিনি দিল্লির সুলতানিকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন । যেভাবে তিনি আভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করেছিলেন, তা প্রশংসনীয় ।

(৩) শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য । তিনি দিল্লির বিখ্যাত কুতুবমিনার -এর নির্মাণকার্য সম্পন্ন করেন । মিনহাজ-উস-সিরাজের মতে তিনি যেভাবে গুণী, হৃদয়বান এবং শিক্ষিত ও ধার্মিক ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন, তা অন্য কোনো সুলতান কখনও করেন নি । এই সব কারণেই ইলতুৎমিসকে দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । 

*****

Related Items

মুসলিমদের আগমনে সংঘাত ও সমন্বয়ী প্রক্রিয়া

মুসলমানরা ভারতে একটি সম্পূর্ণ নতুন ও উন্নত ধর্ম চেতনা ও জীবনাদর্শ নিয়ে এসেছিল । দুটি সম উন্নত মানের ধর্ম ও সংস্কৃতি যখন মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তখন কাউই কাউকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারে না । প্রাথমিক সংঘাত অনিবার্য । এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল । হিন্দু-মুসলমান পরস্পর ...

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ঔরঙ্গজেবের আমল থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল । ঔরঙ্গজেব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতার কারণে সাম্রাজ্যের বিশালায়তন অব্যাহত ছিল । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিভূত হয় । মুঘল সাম্রাজ্যের ...

জায়গিরদারি সংকট ও আঞ্চলিক বিদ্রোহ

ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটলেও তাঁর সময় থেকেই পতনের প্রক্রিয়া সূচিত হয় । জায়গিরদারি সংকট ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ । ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই সংকট তীব্রতর হয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের আমলে একটানা যুদ্ধ ও বিশেষত তাঁর ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি ...

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System)

মনসবদারি প্রথা ও রাজস্ব ব্যবস্থা (Mansabdari System) :

মনসবদারি প্রথা (Mansabdari System) : মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল সামরিক শাসন । জনগণের সেখানে কোন ভূমিকা ছিল না । জনসমর্থন নয়, ভীতিই ছিল এই শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যদিও আগেই বলা হয়

মুঘল আমলে কেন্দ্রীয় শাসন ও সংহতি

আকবরই মুঘল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । রাষ্ট্রশাসনে আকবর সরকারের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের মঙ্গলের কথাও চিন্তা করতেন । তাঁর প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতীয় ও সুলতানি শাসনের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল । বিশেষত শের শাহ প্রবর্তিত শাসন ...