শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে:-
১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত নরেন্দ্রনাথের জীবনের ধারাটিকে পরিবর্তিত করে দেয় । এই সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "তাঁহাকে [রামকৃষ্ণ] একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না । অতি সরল ভাষায় তিনি কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন ? আমি সারা জীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহার নিকটে গিয়া তাঁহাকেও সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, 'মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন ?' তিনি উত্তর দিলেন- 'হাঁ ।' 'মহাশয়, আপনি কি তাঁহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন ?' 'হাঁ' । 'কি প্রমাণ ? ' 'আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাঁহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরও স্পষ্টতর, আরও উজ্জ্বলতররূপে দেখি ।' আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম । আমি দিনের পর দিন এই ব্যক্তির নিকট যাইতে লাগিলাম । ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম । একবার স্পর্শে, একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে । আমি এইরূপ ব্যাপার বারবার হইতে দেখিয়াছি ।" যদিও প্রথমে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের গুরু রূপে স্বীকার করতে সম্মত ছিলেন না । তিনি তাঁর ধ্যানধারণার বিরুদ্ধের প্রায়শই বিদ্রোহ প্রকাশ করতেন । তবু শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বার বার তাঁর দর্শনে ছুটে যেতেন । প্রথম দিকে শ্রীরামকৃষ্ণের তুরীয় আনন্দের ভাব ও দর্শনকে কেবলমাত্র মনগড়া কল্পনা বলে মনে করতেন । ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে তিনি মূর্তিপূজা ও বহুদেববাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন । কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন কালীর উপাসক । অদ্বৈত বেদান্ততত্ত্বকেও নরেন্দ্রনাথ নাস্তিকতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন; এবং মাঝে মাঝেই তা নিয়ে উপহাস করতেন । শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে না পারলেও নরেন্দ্রনাথ তা উড়িয়ে দিতে পারতেন না । কোনো মত গ্রহণ করার আগে তা যাচাই করে নেওয়াই ছিল নরেন্দ্রনাথের স্বভাব । তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেন । শ্রীরামকৃষ্ণও কোনোদিন তাঁকে যুক্তিবর্জনের পরামর্শ দেননি । তিনি ধৈর্য সহকারে নরেন্দ্রনাথের তর্ক ও পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং তাঁকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই সত্য পরীক্ষা করতে বলেন । পাঁচ বছর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থেকে নরেন্দ্রনাথ এক অশান্ত, বিভ্রান্ত, অধৈর্য যুবক থেকে এক পরিণত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন । ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগে স্বীকৃত হন এবং শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের গুরু রূপে স্বীকার করে নিয়ে গুরুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেন । ১৮৮৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন । এই সময় তাঁকে কলকাতার কাশীপুরে স্থানান্তরিত করা হয় । জীবনের অন্তিম পর্বে বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভ্রাতাগণ তাঁর সেবাসুশ্রুষা করেছিলেন । এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে তাঁদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা চলে । কথিত আছে, কাশীপুরেই বিবেকানন্দ নির্বিকল্প সমাধির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন । শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ পর্বে বিবেকানন্দ ও তাঁর কয়েকজন গুরুভ্রাতা গুরুর নিকট থেকে সন্ন্যাসীর গৈরিক বস্ত্র লাভ করেছিলেন । যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম রামকৃষ্ণ সংঘ । গুরুর নিকট থেকে বিবেকানন্দ এই শিক্ষাই পান যে মানবসেবাই সর্বাপেক্ষা কার্যকরী ঈশ্বরোপাসনা । কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্ব নিয়ে বিবেকানন্দের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলে শ্রীরামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন, " যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই রামকৃষ্ণ... " শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অবর্তমানে নিজের শিষ্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন বিবেকানন্দের উপর, এবং তাঁর শিষ্যদেরও বিবেকানন্দকে নেতা বলে স্বীকার করতে বলেন । দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৮৮৬ সালের ১৬ অগস্ট অতিপ্রত্যুষে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাপ্রয়াণ ঘটে । তাঁর শিষ্যদের মতে, এ ছিল তাঁর মহাসমাধি ।
বরানগর মঠ প্রতিষ্ঠা :-
শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর গৃহী শিষ্যদের আর্থিক সহায়তায় বিবেকানন্দের নেতৃত্বে তাঁর তরুণ সন্ন্যাসী শিষ্যরা বরানগরে এক পোড়ো বাড়িতে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন । এটিই ছিল রামকৃষ্ণ সংঘের সদস্যদের দ্বারা স্থাপিত প্রথম মঠ । বরানগরের এই পোড়ো বাড়িটি মঠ স্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয় মূলত দুটি কারণে । প্রথমত বাড়িটির ভাড়া ছিল কম । দ্বিতীয়ত বাড়িটি শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যেষ্টিস্থল কাশীপুর মহাশ্মশানের অত্যন্ত নিকটবর্তী ছিল । নরেন্দ্রনাথ ও মঠের অন্যান্য সদস্যগণ এখানে জপধ্যান করতেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ, শঙ্করাচার্য, রামানুজ ও যীশু খ্রিষ্ট প্রমুখ ধর্মগুরুদের দর্শন ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতেন । এই মঠের প্রথম দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে নরেন্দ্রনাথ পরে বলেছিলেন, "বরাহনগর মঠে আমরা অনেক ধর্মাচরণ করেছি । রাত তিনটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে জপধ্যানে মগ্ন হতাম । সেই দিনগুলিতে বৈরাগ্য কি প্রবল ছিল ! বাইরের জগৎ আছে কি নেই, সেকথা একবার মনেও হত না ।" ১৮৮৭ সালের প্রথম দিকে নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর আটজন গুরুভ্রাতা আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । সন্ন্যাস গ্রহণের পর নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ নাম ধারণ করেছিলেন ।
***