স্বাধীন ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ (Growth of Parliamentary Democracy in Independent India)
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান চালু হয় । ওই দিন থেকেই ভারতবর্ষ স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভের দিন থেকে ভারতীয় গণপরিষদ একাধারে সংবিধান রচনা ও আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে আসছিল । সংবিধান অনুসারে ১৯৫১ - ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল নব প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সামনে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রথম বৃহত্তর পরীক্ষা । ভারত যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল । সদ্য স্বধীনতা প্রাপ্ত ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক তথা ধর্ম, ভাষা, জাতিগত ও উদ্বাস্তু সমস্যা সত্ত্বেও এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের সংবিধানে বর্ণিত সার্বভৌম অধিকার ও ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠা করা হয় । প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে দেশের প্রায় ১০ কোটি ৩০ লক্ষ ভোটদাতা অংশ গ্রহণ করেন । এঁদের মধ্যে আবার ৭০ শতাংশ মানুষ ছিলেন নিরক্ষর । এই নির্বাচন দুই স্তরে বিভক্ত ছিল । কেন্দ্রীয় স্তরে লোকসভা এবং রাজ্য স্তরে বিধানসভা নির্বাচন । কেন্দ্রীয় লোকসভায় ৪৮৯টি এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক আইনসভা অর্থাৎ বিধানসভার মোট ২৮৩টি আসনের জন্য ১৪টি জাতীয় দল; ৬৩টি আঞ্চলিক দল এবং বহুসংখ্যক নির্দল প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন । নির্বাচনে কংগ্রেস দল লোকসভায় ৭৫ শতাংশ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে ৬৮.৫ শতাংশ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে কেন্দ্রে এবং রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস সরকার গঠন করে । কেন্দ্রে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে প্রথম কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা শপথ নেয় । ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন । এরপর জওহরলাল নেহরুর জীবিতকালে ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আরও দুটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ।
১৯৫১-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নির্বাচনে ৪৬ শতাংশ ভোটদাতা নির্বাচনে ভোট দেন এবং ১৯৫৭ ও ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রদত্ত ভোটের হার গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৭ ও ৫৪ শতাংশ । ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল সারা ভারতে যেখানে কংগ্রেসের একচেটিয়া প্রাধান্য সেখানে কেরলে ই.এম.এস. নাম্বুদ্রিপাদ (ইল্লিকুল্লা মনাক্কেল শংকরণ নাম্বুদ্রিপাদ) -এর নেতৃত্বে প্রথম কমিউনিস্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয় । ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্রে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বজায় থাকলেও অনেক রাজ্যে কংগ্রেস পরাজিত হয় এবং অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হয় । তারপর রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রে এবং রাজ্যগুলিতে প্রয়োজন মাফিক অন্তর্বর্তী নির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে । ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের পঞ্চম সংসদীয় নির্বাচন পর্যন্ত ভারতবর্ষে একদলীয় সরকার অর্থাৎ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে শাসনকার্য চালাত । ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হয় । দেশে শুরু হয় বহু দলীয় সরকারের শাসন । ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে একাধিক বিরোধী দল মিলে জনতা দল তৈরি হয় । সেই দলের প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই । ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মোরারজি সরকারের পতন হয় । শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করে । ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্দিরা গান্ধির অকাল মৃত্যু হলে রাজীব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হন । ওই বছরেই লোকসভার সাধারণ নির্বাচনে রাজীব গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে কেন্দ্রে সরকার গঠন করে । কিন্তু ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে রাজীব গান্ধির কংগ্রেসকে হারিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং -এর নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলির একটি জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে । পরের নির্বাচনে কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে । পি.ভি. নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় কংগ্রেস সরকার । দু-একটি ছোটো দলের সাহায্যে সেই সরকার পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকেছিল । তারপর থেকে আর কোনো দলই লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় নি । ফলে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে শুরু হয় একাধিক সমমনোভাবাপন্ন দলের সমবায়ে গঠিত কোয়ালিশন সরকার । ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে লোকসভার চতুর্দশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে এরূপ একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন জাতীয় কংগ্রেস এবং তার প্রধানমন্ত্রী হলেন ডঃ মনমোহন সিং ।
*****
- 6762 views