Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 19:23

সর্বদলীয় সম্মেলন-১৯২৮ :

ব্রিটিশ শাসকদের প্ররোচনায় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ক্রমে বিলীন হতে থাকে । এই সময় ভারতসচিব লর্ড বার্কেনহেড ঘোষণা করেন, ভারতীয়রা সার্থক কোনো সংবিধান রচনা করতে পারবে না । বার্কেনহেডের এই মন্তব্যে ভারতে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ অসন্তুষ্ট হন । তাঁরা  ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ধারণা ভূল প্রতিপন্ন করে হিন্দু-মুসলিম বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি আদর্শ সংবিধান রচনা করার চেষ্টা চালাতে থাকেন । দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতা এমনকি মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রদায়িক দলগুলিও ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বিরোধী বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করেছিল । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে ডঃ আনসারির সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সম্মেলন বসে । এই সম্মেলনে স্বরাজ্য দলের নেতা মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় । মতিলাল নেহরুর নাম অনুসারে কমিটির নাম হয় নেহরু কমিটি । কমিটির ওপর ভারতের জন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় । প্রখ্যাত আইনজ্ঞ তেজবাহাদুর সাপ্রু নেহরু কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে নেহরু কমিটি লখনউ অধিবেশনে ভারতীয় সংবিধানের খসড়া সম্বলিত একটি রিপোর্ট পেশ করেন । এটি নেহরু সাংবিধান বা নেহরু রিপোর্ট নামে পরিচিত হয় । এই খসড়া সংবিধানে ভারতকে একটি অধিরাজ্যের মর্যাদা (Dominion Status) দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় । কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে দায়িত্বশীল সরকার গঠন এবং কয়েকটি আসন সংরক্ষণ ছাড়া যৌথ নির্বাচন প্রথা চালু করার দাবি জানানো হয় । এছাড়া সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দান এবং ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলা হয় । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে এই খসড়া সংবিধান অনুমোদনের জন্য কলকাতায় আবার একটি সর্বদলীয় সম্মেলন ডাকা হয় । সম্মেলনে সংবিধান অনুমোদনকে কেন্দ্র করে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । কংগ্রেসের তরুণ সম্প্রদায় পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় তাঁরা 'ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসে' খুশি হতে পারেন নি । কংগ্রেসের দুই তরুণ সদস্য সম্মেলনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি সম্বলিত এক সংশোধনী প্রস্তাব রাখেন । কিন্তু সেটি অগ্রাহ্য হয়ে যায় ও শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের সম্মতিক্রমে নেহরু সংবিধান অনুমোদিত হয় ।

সর্বদলীয় ঐক্যমত্য বেশি দিন স্থায়ী হয় নি । মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম লিগের পক্ষে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলী ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত 'চৌদ্দ দফা' দাবি পেশ করেন । দাবিগুলি অগ্রাহ্য হয়ে যাওয়ায় মহম্মদ আলি জিন্না নেহরু সংবিধান বর্জন করেন । এছাড়া শিখ সম্প্রদায় ও অনুন্নত হিন্দু সমাজের কোনো কোনো প্রতিনিধিও নেহরু সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে স্বাধীনতাকে জাতীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য রূপে গ্রহণ করা হয়েছিল । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সর্বদলীয় সম্মেলনে তরুণ কংগ্রেসি জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু পূর্ণ স্বরাজ বা স্বাধীনতা -র দাবি উত্থাপনের জন্য চাপ দিতে থাকলেও তাঁদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়ে যায় । কিন্তু তাঁদের বক্তব্য কংগ্রেসের বামপন্থী নেতৃবৃন্দের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল । প্রস্তাব নেওয়া হয় যে, ব্রিটিশ সরকার এক বছরের মধ্যে নেহরু কমিটি প্রস্তাবিত ভারতীয় অধিরাজ্যের দাবি মেনে নেবে, না হলে এক বছর পরে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করবে । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর সেই সময়সীমা অতিক্রান্ত হলেও সরকারের দিক থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় নি । ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধি, মহম্মদ আলি জিন্না, তেজবাহাদুর সাপ্রু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বড়লাট আরউইনের সঙ্গে দেখা করে আরউইনকে ভারতীয়দের অধিরাজ্যের মর্যাদা দান এবং সংবিধান রচনা সংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিরুত্তর থাকেন । শুধু তাই নয় ভারতীয়দের দাবিদাওয়া সম্পর্কেও ব্রিটিশ সরকার যথারীতি নিরুত্তর থাকেন । এক রকম শূন্য হাতেই দলবল সমেত গান্ধিজি ফিরে আসেন ও যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পড়েন । তারপর তিনি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপোষের নীতি পরিহার করে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু করতে মনস্থ করেন ।

*****

Related Items

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Quit India Movement and the Working Class):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেয় । এই আন্দো

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (The Civil Disobedience Movement and the Working Class) :-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শ্রমিকরা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট শ

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (Workers and Peasants Party) :-

কুতুবুদ্দিন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক হেমন্ত সরকার, সামসুদ্দিন হোসেন প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর বাংলায় 'লেবার স্বরাজ পার্টি অব দা ইন্ডিয়ান

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Non Co-operation Movement and the Working Class):- 

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় সারা ভারতে শ্রমিকরা আন্দোলনে শামিল হয় । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী ওঠে । শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো, ব

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Anti-Partition Movement and the Working Class):-

ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা না করলেও ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত শ্রমিক