মহাত্মা গান্ধি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রূপান্তর (Mahatma Gandhi and The Transformation of Indian Nationalism)
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি এক অবিস্মরনীয় নাম । তাঁর জীবনাদর্শ, নীতি ও কর্মপদ্ধতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায় । অহিংস সত্যাগ্রহ, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেন । তাঁর এই অভিনব রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য জাতীয় রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নেয় । চরমপন্থী রাজনীতি, নরমপন্থী আদর্শ কিংবা বৈপ্লবিক তথা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ তাঁর মতাদর্শে প্রভাবিত হয় ।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা অক্টোবর গুজরাটের কাথিয়াবাড় -এর অন্তর্গত পোরবন্দর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম কাবা গান্ধি, মাতার নাম পুতলী বাই । ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যান । ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং বোম্বাই হাইকোর্টে কিছুদিন ওকালতি করেন । এরপর ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ার ব্যবসায়ী 'দাদা আবদুল্লা অ্যান্ড কোম্পানির' পক্ষে একটি মামলায় সওয়াল করার উদ্দেশ্যে তাঁদের ডাকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান । দক্ষিণ আফ্রিকায় উপনীত হয়ে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার ও নিপীড়ন দেখে গান্ধিজি বিচলিত হয়ে পড়েন । বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বর্ণবিদ্বেষের অবসান ঘটানোর জন্য তিনি সেখানকার সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের সংঘবদ্ধ করে তাঁদের মধ্যে আত্মসচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, সততা এবং নিয়ম নিষ্ঠাবোধ সঞ্চারে সচেষ্ট হন । এভাবে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মনোনিবেশ করেন । তাদের স্বার্থের পরিপন্থী নাটাল সরকারের আনা সকল প্রকার আইনের বিরোধিতা করে জনমত সংগঠিত করতে থাকেন । এ সময় নাটাল পার্লামেন্টে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার খর্ব করা হয় ও দক্ষিণ আফ্রিকায় চুক্তি নবীকরণে অরাজি ভাড়াটে শ্রমিকদের ওপর মাথাপিছু তিন পাউন্ড হারে কর ধার্য করা হয় । গান্ধিজি এই উভয় প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের নিয়ে তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন । প্রস্তাবের বিপক্ষে দশহাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র ইংল্যান্ডের রানির কাছে পাঠানো হয় । আফ্রিকার বুওর যুদ্ধে আহত ব্রিটিশ সৈনিকদের সেবা করে তিনি ইংল্যান্ডবাসীর প্রশংসা লাভ করেন । গান্ধিজির ব্যক্তিত্ব এবং সেবামূলক মনোভাব ইংরেজদের গান্ধিবিদ্বেষ কিছুটা কমালেও তাতে কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয়দের প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার নীতির কোনো পরিবর্তন হয় নি । উপরন্তু ট্রান্সভাল সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার এশিয়াবাসীদের অরেজিস্ট্রিকৃত সকল বিবাহকে অসিদ্ধ বলে বাতিল করে । ভারতীয় শ্রমিকদের মাথাপিছু তিন পাউন্ড হারে কর দিতে বাধ্য করা হয় । গান্ধিজি এসবের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহের ডাক দেন । সত্যাগ্রহ হল এক ধরণের অহিংস প্রতিরোধ যাতে সত্যাগ্রহীকে অন্যায়কারীর আঘাত ও নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করতে হয়, এমনকি সকল প্ররোচনাতেও তাঁকে নিজ আদর্শ ও নিষ্ঠার প্রতি অবিচল থাকতে হবে । সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে গান্ধিজির আন্দোলন তাঁকে চূড়ান্ত জয় এনে দিয়েছিল । সেখানকার সংগঠিত ভারতীয়দের প্রবল আন্দোলন ও জনমতের চাপে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয় । এভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে গান্ধিজির সত্যাগ্রহের প্রয়োগ এবং সাফল্য তাঁকে ভারতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় এনে হাজির করেছিল । মহামতি গোখেল তাঁকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানালে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন । ভারতীয় রাজনীতিতে তখনও চরমপন্থীদের প্রাধান্য থাকায় গান্ধিজি গুজরাটে ফিরে যান । সবরমতী নদীর তীরে সত্যাগ্রহ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করে তিনি তাঁর অনুগামীদের সত্যাগ্রহের আদর্শ ও পদ্ধতি শিক্ষা দিতে মনোনিবেশ করেন ।
ভারতে ফিরে এসে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, কংগ্রেস ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হলেও প্রকৃত গণসংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি । দেশের কৃষক ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের কাছে কংগ্রেসের নীতি ও কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না । তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে দেশের কৃষক ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ছাড়া ভারতে প্রকৃত গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয় । এদেশের দুর্দশাগ্রস্থ শ্রমিক ও কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর সত্যাগ্রহের নীতি প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন । গান্ধিজির একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল এই সত্যাগ্রহ নীতি প্রয়োগের দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রকৃত জাতীয় আন্দোলনে উন্নীত করা ।
*****
- 7908 views