Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 12/07/2020 - 12:33

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ স্বীকৃত ছিল না । অত্যন্ত অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে বয়স্ক এমন কি বৃদ্ধদেরও বিবাহ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল । ফলে অনেক সময় অল্প বয়সেই মেয়েরা বিধবা হত । এর পরিপেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন সমাজসংস্কারক এই সময় বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলেন । আঠারো শতকে ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ তার বিধবা শিশুকন্যার পুনর্বিবাহ দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হলেও তৎকালীন নদিয়ার পণ্ডিতদের বিরোধিতায় তাঁর সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয় । জয়পুরের মহারাজা, কোটার শাসকও বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন । পরবর্তীকালে রামমোহন রায়ের আত্মীয় সভা, ব্রাহ্মসমাজ এবং ডিরোজিও -র নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গড়ে তোলে । ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ক্যালকাটা প্রেস ক্লাব, তত্ত্ববোধিনী সভা, সুহৃদ সভা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি বিধবা বিবাহের পক্ষে নিজেদের মতামত প্রচার করে । তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সংবাদ ভাস্কর সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগ ও আন্দোলনের ফলে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও বিধবাদের বিবাহ দেওয়া সম্পর্কে তেমন কোন উদ্যোগ তাঁর পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি । এ বিষয়ে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় প্রথম বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রবন্ধ লেখেন এবং বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য জনমত গঠন করতে শুরু করেন । তিনি বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে বিধবা বিবাহের সপক্ষে লেখালেখি শুরু করেন । তিনি সর্বশুভকরী সভার মুখপত্র 'সর্বশুভকরী পত্রিকা'র প্রথম সংখ্যায় 'বাল্যবিবাহের দোষ' নামে এক প্রবন্ধে বিধবা বিবাহের কারণ তুলে ধরেন । 'পরাশর সংহিতা' থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন । বিধবাবিবাহের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য 'বিধবাবিবাহ ..... এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' নামে বিধবা বিবাহের সমর্থনে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রচার করতে শুরু করলে তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় । রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে রক্ষণশীল হিন্দুরা সভাসমিতির আয়োজন ও নানা পুস্তিকা প্রকাশ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন । সমালোচনা ও বিদ্রুপের জবাব দিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' নামে দ্বিতীয় পুস্তিকা প্রকাশ করন । বিধবা বিবাহকে আইনসিদ্ধ করার জন্য ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তিনি ভারতীয় আইন সভার সদস্যদের কাছে ৯৮৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ এক আবেদনপত্র পাঠান । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি এই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন । এই আবেদনপত্রের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ৩৬,৭৬৩ জনের স্বাক্ষর করা এক দরখাস্ত সরকারের কাছে পাঠানো হয় । শেষ পর্যন্ত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে রাধাকান্তদেব ও রক্ষণশীলদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই ১৫নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন পাস করেন ।

বিধবা বিবাহ আইন পাস হলেও তা বাস্তবায়িত করা ছিল ভীষণ কঠিন । এই ব্যাপারে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর -ই প্রথম সচেষ্ট হন । তাঁর উদ্যোগে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর বাংলায় প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় । এতে পাত্র ছিলেন ২৪ পরগনা জেলার শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, আর পাত্রী ছিলেন বর্ধমানের পলাশডাঙ্গার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দশ বছরের বিধবা মেয়ে কালীমতি দেবী । ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিদ্যাসাগর নিজের থেকে ৮২ হাজার টাকা খরচ করে মোট ৬০ জন বিধবার বিবাহ দেন । দরিদ্র বিধবাদের বিবাহ দেওয়ার জন্য তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে 'হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড' গঠন করেন । ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গেও ভবসুন্দরী নামে এক অষ্টাদশী বিধবার বিবাহ দেন । বিধবা বিবাহের প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে এক পত্রে জানান, "বিধবা বিবাহ প্রথা প্রবর্তন আমার জীবনের প্রধান সৎকর্ম ।"

******

Comments

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?