উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলার সমাজজীবনে বিভিন্ন ধরণের কুপ্রথা প্রচলিত ছিল । সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসীপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, কৌলিন্য প্রথা, গঙ্গাজলে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি নানান অমানবিক কুপ্রথা ও মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাস বাংলার সমাজজীবনকে জর্জরিত করে রেখেছিল ও সমাজজীবনের অগ্রগতির ধারাকে রুদ্ধ করে রেখেছিল । আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ঊনিশ শতকে ব্রাহ্মসমাজসমূহ সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । যুক্তি, বুদ্ধি, মানবতাবাদ, সামাজিক ন্যায় প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন পরিচালিত হয় । ব্রাহ্মনেতারা আধুনিক যুক্তি দিয়ে সামাজিক কুসংস্কারগুলিকে দূর করতে সচেষ্ট হন । তাঁরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সভাসমিতি আয়োজন করে সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার চালান । বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলিতে তাঁরা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখে জনমত গঠনের প্রয়াস চালান । ব্রাহ্মনেতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা হল হিন্দুজাতির অধঃপতনের আসল কারণ । তাই এই সমস্ত কুপ্রথার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে তাঁরা আন্দোলন গড়ে তোলেন ও বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কুলিন প্রথা ইত্যাদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেন । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরবর্তী সময়ে, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, অক্ষয়কুমার দত্ত, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্মনেতারা ধর্মসংস্কারের থেকে সমাজসংস্কারে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন । তাঁরা স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার, পর্দাপ্রথা বিলোপ, অসবর্ণ বিবাহ প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজ সংস্কারের কর্মসূচিতে বিশ্বাসী হলেও কিন্তু কেশবচন্দ্র ও তরুণ ব্রাহ্মনেতাদের মতো তিনি চরমপন্থী ছিলেন না । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনাধীন 'আদি ব্রাহ্মসমাজ' সমাজ সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দেয়নি ।
কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' বিধবাবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, অসবর্ণ বিবাহ, নৈশ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, পতিত মেয়েদের উদ্ধারসহ নানান সামাজিক কাজে লিপ্ত হয় ও বাল্যবিবাহ, মদ্যপান ও পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হয় । ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে এক পয়সা দামে 'সুলভ সমাচার' নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় । এই পত্রিকার মাধ্যমে সাধারণের মধ্যে নীতিশিক্ষার প্রচার চালানো হয় । শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে 'ভারত শ্রমজীবি' পত্রিকা প্রকাশিত হয় । 'মদ-না-গরল' নামে এক পয়সা দামের পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সুরা পানের কুফল তুলে ধরা হয় । বয়স্কদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য কেশবচন্দ্র সেন কলকাতার কলুটোলায় এক নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি 'ব্রাহ্ম বন্ধু সভা' ও 'সংগত সভা' প্রতিষ্ঠা করেন । স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি 'বামাবোধিনী সভা' ও 'ব্রাহ্মিকা সমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন এবং মাসিক 'বামাবোধিনী পত্রিকা' প্রকাশ করেন । নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য 'নেটিভ লেডিস নর্মাল স্কুল' গড়ে তোলেন । পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য কেশবচন্দ্র সেন নিজের স্ত্রীকে প্রকাশ্য প্রার্থনা সভায় যোগদানের অনুমতি দেন । তাঁর উদ্যোগে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় বিবাহ আইন পাশ করে । এই আইনের দ্বারা অসবর্ণ বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয় । এই আইন অনুযায়ী পাত্রের বয়স ১৮ এবং পাত্রীর বয়স ১৪ নির্ধারিত হয় ।
শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গা মোহনদাস প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্মনেতাদের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের মতবিরোধ ঘটায় তারা 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' থেকে আলাদা হয়ে 'সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ সমাজসংস্কার আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলে । নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী স্বাধীনতার সপক্ষে ও বাল্যবিবাহের বিপক্ষে প্রচার চালিয়ে শিক্ষার বিস্তার, নারীসমাজের উন্নয়ন, অস্পৃশ্যতা নিবারণ প্রভৃতি কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বলা যায় ব্রাহ্মসমাজসমূহের সামাজিক আন্দোলনের ফলে ঊনিশ শতকের বাংলার অচল-অনড় হিন্দুসমাজে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে ।
******