বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 02/25/2021 - 21:08

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন (Namasudra Movement in Bengal):-

হিন্দু জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার উল্লেখযোগ্য দলিত হিন্দু সম্প্রদায় । নমঃশূদ্ররা হিন্দু জাতিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত । নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল । এছাড়াও নমঃশূদ্ররা সরকার ও জামিদারদের দ্বারা বিভিন্নভাবে শোষিত হত । অশিক্ষা, বিনা চিকিৎসা, দারিদ্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ছিল নমঃশূদ্রদের জীবনের নিত্যসঙ্গী । সমাজের সকলের সঙ্গে তারা শিক্ষা, চিকিৎসা, বিভিন্ন পরিসেবা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল । পূর্ববঙ্গের ঢাকা, যশোহর, ময়মন সিংহ, বাখর গঞ্জ, খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় নমঃশূদ্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল । এ ছাড়াও পূর্ব বাংলার সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, মেঘনার অববাহিকা, সিলেট, জলপাইগুড়ির প্রভৃতি অঞ্চলে নমঃশূদ্রদের বসবাস ছিল । কৃষিকাজ ছিল নমঃশূদ্রদের প্রধান জীবিকা । ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের জনসমীক্ষা থেকে জানা যায় উপার্জনশীল নমঃশূদ্রদের শতকরা ৭৮ ভাগই ছিল কৃষিজীবী, চাষি এবং জনমজুর ।

অবিভক্ত বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল দলিত আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । বাংলার অনুন্নত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় বিশেষভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল । বর্ণহিন্দুদের একাধিপত্য, সামাজিক অত্যাচার, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্রেরা আন্দোলন শুরু করে । বিশেষ অধিকার অর্জন করে নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে নমঃশূদ্র মতুয়ারা ছাড়াও তেলী, মালি, কুম্ভকার, চামার, কপালি, কামার, পোদ, মালাকার প্রভৃতি শ্রেণি এই দলিত আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে । নমঃশূদ্রদের মধ্যে একটি ছিল শিক্ষিত ও কর্মক্ষেত্রে সফল শ্রেণি ও অপরটি ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র শ্রেণি । উভই শ্রেণিই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় সচেষ্ট হয়েছিল ।

মতুয়া ধর্মসম্প্রদায় প্রচলিত হিন্দুধর্মের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল । বৈষ্ণবদের মতোই মতুয়াদের ধর্মগুরু শ্রীগুরু চাঁদ ঠাকুর ভক্তিবাদ গুরুবাদ জাতিভেদের অবসান এবং সাম্যের আদর্শ প্রচার করেন । তিনি কর্মের নীতিকেও গুরুত্ব দেন । হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুগামীদের ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের মন্দিরে বা অনুষ্ঠানে না গিয়ে হরিমন্দির নির্মাণ করে পূজা অর্চনায় উদ্যোগী হতে বলেন । বেদকে অগ্রাহ্য করে তিনি মানুষকে সকলের উর্দ্ধে স্থান দেওয়ার কথা বলেন । ঈশ্বর গুরুর পিতৃত্ব এবং মানুষের ভ্রাতৃত্ব—এই দুটি তাঁর মূল্যবান বাণী ছিল । তিনি বলেন হাতে কাম মুখে নাম —এই মন্ত্রেই মানুষের মুক্তি লাভ ঘটবে । অনুগামীদের সংঘবদ্ধ ও উদবুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর অনুগামীদের শ্রদ্ধাস্পদ হওযার, নিজেকে শিক্ষিত করে তোলার এবং অর্থ উপার্জন করার উপদেশ দিতেন ।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের অনুগামীদের উদ্যোগে নমঃশূদ্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে 'উন্নয়নী সভা' আয়োজিত হয় । মতুয়াদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঐক্য সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে 'বারুনী মেলা' আয়োজিত হয় । ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে 'বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন' স্থাপিত হয় । অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব বঙ্গের জেলাগুলিতে এই সংগঠনের শাখা গড়ে উঠতে শুরু করে ও জেলায় জেলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের ভিত গড়ে ওঠে । নমঃশূদ্র আন্দোলন পরিচালনাকারী নেতাদের প্রধান দাবি মেনে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের জনসমীক্ষায় অসম্মানজনক 'চন্ডাল' নামের পরিবর্তে 'নমঃশূদ্র' নামটিকে আইনগত ও আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দিয়ে নমঃশূদ্র নামের ব্যবহার শুরু হয় । বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ, বিধবা বিবাহের প্রচলনে উদ্যোগী হওয়া, জাতিভেদ প্রথা বর্জন, সৎ এবং নৈতিকভাবে জীবনযাপন করা প্রভৃতি নমঃশূদ্র আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে ছিল । ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এবং কলকাতায় আয়োজিত নমঃশূদ্রদের সম্মেলনে সমাজে নমঃশূদ্রদের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরা হয় ও বর্ণহিন্দু ভূস্বামীদের শোষণ থেকে নমঃশূদ্রদের মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয় ।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার আইনে বঙ্গীয় আইন সভায় অনুন্নত শ্রেণির জন্য এক প্রতিনিধি মনোনয়ন করা হয় । ১৯৩০ -র দশকে নমঃশূদ্রদের একাংশ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট ঘোষিত 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি' (Communal Award) -কে সমর্থন করে । এসময় থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিরাটচন্দ্র মন্ডল প্রমুখের নেতৃত্বে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকরা সংগঠিত হয় ও কৃষক প্রজাপার্টিকে সমর্থন জানায় । হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল নমঃশূদ্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিডিউল কাস্ট পার্টি' গঠন করে জাতীয় কংগ্রেসকে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেন । ১৯৪০ -র দশকে নমঃশূদ্ররা কখনো হিন্দু মহাসভার সহযোগী হয়, কখনো বা মুসলমানদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়, আবার কখনো বা বামপন্থীদের পরিচালিত তেভাগা আন্দোলনে অংশ নেয় । এ ছাড়া নমঃশূদ্রদের অনেকেই নিজেদের পদবি বদলে মনোমতো পদবি গ্রহণ করে উঁচু জাতে ওঠার চেষ্টা করে ।

*****

Comments

Related Items

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন (Quit India Movement and the Peasantry):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেয় । এই আন্দোলনের আগেই দেশ

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন (Civil Disobedience Movement and the Peasantry):-

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । এই অর্থনৈতিক মন্দা ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে । ভারতের কৃষিজাত পণ্যের দাম আন্

বারদৌলি সত্যাগ্রহ (Bardoli Satyagraha)

বারদৌলি সত্যাগ্রহ (Bardoli Satyagraha):-

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর বন্যায় বারদৌলি অঞ্চলে প্রচুর ফসল নষ্ট হলে সেখানকার কৃষকরা দুর্ভিক্ষের শিকার হয় । এই পরিস্থিতিতে সরকারি রাজস্ব বিভাগের নির্দেশে বারদৌলিতে ৩০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয় । নবজীবন ও

একা আন্দোলন (The Eka Movement)

একা আন্দোলন (The Eka Movement):-

মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে উত্তরপ্রদেশে এই আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায় । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে ও ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন (The Non Co-operation Movement and the Peasants) :-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড প্রভৃতির প্রতিবাদে গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহ