দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক (Debate Between Gandhi and Ambedkar Regarding Dalit Rights):-
ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় জুড়ে সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষ উপেক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত । সমাজের তথাকথিত ওপর তলার উচ্চবর্ণ ও উচ্চবর্গের শিক্ষিত মানুষ রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির সবকিছুর হাল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের করায়ত্ত করে রাখত । নিচু তলার মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে সমাজের ওপর তলার মানুষদের সমীহ করে চলত বা চলতে বাধ্য হত । তারা সমাজের ওপর তলার মানুষদের ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করার সাহস করত না । উচ্চশ্রেণির মানুষরা ছিল নেতা এবং নিম্নশ্রেণির মানুষরা ছিল তাদের অনুগামী । প্রয়োজন ছাড়া এই নেতারা নিম্নশ্রেণির মানুষদের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক রাখত না । নিম্নশ্রেণির মানুষদের নিজস্ব মতামত সম্বন্ধে উচ্চশ্রেণির মানুষরা বরাবরই উদাসীন ছিল । উনিশ শতকের শেষদিক থেকে অব্রাহ্মণ, নীচু জাতের হিন্দু ও অস্পৃশ্য সম্প্রদায় তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে ।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথমদিকে সামাজিক সমস্যাকে কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি । জাতীয় কংগ্রেসে গান্ধিজির উত্থানের পর থেকে অস্পৃশ্যতার মত সামাজিক বিষয়টি জাতীয় কংগ্রেস গুরুত্ব দিতে শুরু করে । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের অসহযোগ প্রস্তাবে স্বরাজ অর্জনের পূর্ব শর্ত হিসেবে গান্ধিজি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে মনসংযোগ করেন । অস্পৃশ্যতার মত সামাজিক সমস্যাকে নিন্দা করলেও গান্ধিজি বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অর্থাৎ সমাজে প্রচলিত বর্ণভেদ প্রথা সমর্থন করে বলেন, "বর্ণব্যবস্থা যদি বৃক্ষ হয়, অস্পৃশ্যতা তবে পরগাছার মতো । পরগাছাকে কাটতে গিয়ে আমরা যেন ভুল করে বৃক্ষ কেটে না বসি ।" গান্ধিজি মনে করতেন বর্ণব্যবস্থা ধ্বংস হলে বর্ণ এবং অবর্ণের মধ্যে একটি রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হবে । আম্বেদকর গান্ধিজির এই ধারণার বিরোধিতা করেন । অসহযোগ আন্দোলনের শেষে গান্ধিজির সংস্কার কর্মসূচিগুলি দলিতদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সমীক্ষা চালাবার জন্য সাইমন কমিশন ভারতে এলে আম্বেদকর সাইমন কমিশনের কাছে প্রথম দলিতদের জন্য আলাদা নির্বাচনক্ষেত্র সংরক্ষণের দাবি পেশ করেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মে সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড সাইমন কমিশনের রিপোর্ট বিচার বিবেচনার জন্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই নভেম্বর ভারতের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের এক বৈঠক আহ্বান করেন । যেটি 'প্রথম গোলটেবিল বৈঠক' নাম পরিচিত । এই বৈঠকেও আম্বেদকর দলিতদের জন্য আলাদা নির্বাচনক্ষেত্র সংরক্ষণের দাবির পুনরাবৃত্তি করেন । দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনক্ষেত্র সংরক্ষণের দাবির প্রশ্নে গান্ধিজির সঙ্গে আম্বেদকরের মত পার্থক্য ঘটে । গান্ধিজি এই ধারণা পোষণ করতেন যে, দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনক্ষেত্র সংরক্ষিত হলে হিন্দু সমাজে স্থায়ী ভাঙ্গন দেখা দেবে ।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । এই বৈঠক চলাকালে ভারতের সাম্প্রদায়িক দলগুলির সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নিয়ে টানাটানি ব্রিটিশ সরকারের নজর এড়ায় নি । সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে মদত দিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করতে ও ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যর্থ করে দিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট তাঁর 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি' (Communal Award) ঘোষণা করেন । এই নীতি অনুসারে মুসলমান, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান এবং অনুন্নত সম্প্রদায় সমূহকে পৃথক নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হয়েছিল । এই ঘোষণায় তপশিলি জাতি এবং অন্যান্য অনুন্নত হিন্দুদের বর্ণহিন্দুদের থেকে পৃথক সম্প্রদায় রূপে গণ্য করার কথা বলা হয়েছিল । সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারায় হিন্দুজাতির অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা হওয়ায় মহাত্মা গান্ধি ভীষণ ভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই ব্যবস্থা হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অস্পৃশ্যতাকে উৎসাহিত করবে । গান্ধিজি এই নীতির প্রতিবাদে পুনার যারবেদা জেলে বন্দি অবস্থায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন । আমরণ অনশনে গান্ধিজির অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলে শেষপর্যন্ত কংগ্রেস নেতা মদনমোহন মালব্যের উদ্যোগে গান্ধিজি ও দলিত সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকরের মধ্যে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর পুনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ও গান্ধিজি অনশন ভঙ্গ করেন । চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দলিতদের আলাদা নির্বাচক মন্ডলীর বিষয়টি বাতিল হয় । পরিবর্তে দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৭১ থেকে বাড়িয়ে ১৪৭ করা হয় । কেন্দ্রীয় আইন সভাতেও দলিতদের জন্য ১৮ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয় । চুক্তি অনুসারে অনুন্নত এবং তপশিলি হিন্দুদের সঙ্গে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের যৌথ নির্বাচনের ব্যবস্থা হয় ।
পুনা জেল থেকে মুক্তিলাভের পর গান্ধিজি পরবর্তী দু-বছর হরিজন আন্দোলনে নিয়োজিত হন । তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে 'নিখিল ভারত অস্পৃশ্যতা বিরোধী লিগ' গঠন করেন । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে 'হরিজন পত্রিকা' প্রকাশিত হয় । দলিত ও নিপীড়িতদের গান্ধিজি হরিজন নামে অভিহিত করেছিলেন । পুনা চুক্তিকে আম্বেদকর মন থেকে মেনে নিতে না পারায় তিনি উচ্চবর্ণের নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেস দল থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে থাকেন ও স্বতন্ত্রভাবে দলিত স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন । দলিতদের স্বার্থরক্ষা করার উদ্দেশ্যে তিনি 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি' নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন । ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা দলিত গোষ্ঠীগুলিকে একটি সংগঠনভুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে সর্বভারতীয় তপশিলি ফেডারেশন (All India Scheduled Caste Federation) গঠন করেন । শেষপর্যন্ত ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর গান্ধির বর্ণ হিন্দুবাদী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন ।
****