ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Iswarchandra Vidyasagar)

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 23:04

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Iswarchandra Vidyasagar) :

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হলেন উনবিংশ শতাব্দীর সমাজ-সংস্কার ও শিক্ষা প্রসার আন্দোলনের প্রাতঃস্মরনীয় মহাপুরুষ । তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভগবতী দেবী । কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিনি পড়াশুনা করেন । ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায়, জ্যোতিষ ও ধর্মশাস্ত্র বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এবং পরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন । সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষরূপে তিনি এই কলেজের আমূল সংস্কার ও পুনর্গঠন করেছিলেন । মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বই লেখার কাজে ব্রতী হন । বাংলা গদ্য তখনও গড়ে ওঠেনি । কেবল রাজা রামমোহন রায় আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত কিছুটা এই বিষয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন । এঁদের রচনা ছিল বেশ আড়ষ্ট ও জটিল । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা গদ্যকে সরস ও মধুর করে সাধারণের হৃদয়বেদ্য করে তুলেছিলেন । এজন্য তিনি 'বাংলা গদ্যের জনক' নামে খ্যাত । সে যুগে বাঙালি ছাত্রদের উপযোগী কোনো পাঠ্যপুস্তক ছিল না । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাদের জন্য প্রথম বর্ণপরিচয়, কথামালা, ঋজুপাঠ, আখ্যানমঞ্জরী, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তক লেখেন । অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থের মধ্যে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস', 'ভ্রান্তিবিলাস', প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।

শিক্ষা বিস্তার (Educational Reforms) :

শিক্ষা প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান—

(ক) শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে ।

(খ) স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি রামগোপাল ঘোষ, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ব্যক্তিদের সাহায্য ও সহযোগিতা পান । বিদ্যালয় পরিদর্শকের সরকারি পদে থাকার সুবাদে তিনি ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় এবং ১০০ টি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন । এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় ’ বর্তমান বেথুন স্কুল স্থাপন করা । সংস্কৃত-শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি সংস্কৃত কলেজে অ-ব্রাহ্মণ শ্রেণির ছাত্রদের ভর্তির ব্যবস্থা করেন ।

(গ) ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর গ্রাম বীরসিংহে একটি অবৈতনিক 'ইঙ্গ সংস্কৃত বিদ্যালয়' স্থাপন করেন । উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি 'মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন' প্রতিষ্ঠা করেন ।

(গ) গণশিক্ষার প্রসারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের গুরুত্ব অনুভব করেন । এই জন্য তিনি সহজ-সরল পাঠ্যপুস্তক রচনায় আগ্রহী হন । শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি বর্ণপরিচয়, কথামালা, ঋজুপাঠ, আখ্যানমঞ্জরী, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তক লেখেন । অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থের মধ্যে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস', 'ভ্রান্তিবিলাস', প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।

সমাজ সংস্কার (Social Reforms) :

সমাজ-সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান—

বাংলার সংস্কার আন্দোলন, বিশেষত নারীকল্যাণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান চিরস্বীকার্য । উনিশ শতকের নবজাগরণ ছিল তাঁর সমাজ-সংস্কার ও শিক্ষা প্রসার আন্দোলনের সার্থক পরিণতি ।

(১) পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যকলাপ বাংলা তথা ভারতের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে । বাল্য বিবাহ নিবারণ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণীয় । তাঁর প্রচেষ্টায় গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহকে আইন সিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন । এছাড়া প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিটাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয় ।

(২) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে ধর্মকে সংযুক্ত না করে মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হন । বিদ্যাসাগর ছিলেন একক সংগ্রামী— তিনি কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে প্রয়াসী হননি । রাজা রামমোহনের মতো ব্রাহ্মসমাজ অথবা ডিরোজিও -র নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেননি ।

ভারতীয় নারীদের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান (Contribution of Iswarchandra Vidyasagar for Welfare of Indian women)

উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় । পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এই সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ । তাঁর পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল । প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সামাজ জীবনকে কলুষমুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন । উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কারের প্রধান দিকটি ছিল নারী জাতির কল্যাণসাধন ।

(১) উনবিংশ শতকের এক বিরাট পণ্ডিত ও মহান সমাজ-সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । সারাজীবন ধরে তিনি সমাজ-সংস্কারে ব্রতী থাকেন । বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে । বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন ।

(২) হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন ।

(৩) বহুবিবাহ, বাল্য-বিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল জনমত গড়ে তোলেন । শেষ পর্যন্ত তাঁর আন্দোলন সফল হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ হয় ।

(৪) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর বাল্য-বিবাহের বিরুদ্ধে জোর প্রচার শুরু করেন এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদন পত্র সরকারের কাছে পেস করেন । প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিটাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয় ।

(৫) নারীশিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারেও তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না । বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে থাকার সু্যোগে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন । এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ বর্তমান বেথুন স্কুল স্থাপন করা ।

*****

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা