আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসাবে সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 09/23/2020 - 17:51

আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসাবে সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব :

বিগত শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাসের উপাদান হিসাবে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, প্রাচীন সাহিত্য, বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ, প্রাচীন শিলালিপি, মুদ্রা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে ঐতিহাসিক তাঁর ব্যক্তিগত অনুভব এবং বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করতেন । প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ইত্যাদি এবং মধ্যযুগের ক্ষেত্রে ফারসি, আরবি, ফরাসি, ইংরেজি প্রভৃতি বিদেশি ভাষার ওপর দখল থাকা অত্যাবশ্যক । আধুনিক ভারতের অধিকাংশ উপাদান ইংরেজি ভাষায় লিখিত হওয়ায় আধুনিক ইতিহাসচর্চা গবেষকদের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক হয়েছে । আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানগুলির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হল— (১) সরকারি নথিপত্র, (২) আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা, (৩) চিঠিপত্র এবং (৪) সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র ।

(১) সরকারি নথিপত্র :  ব্রিটিশ শাসনকালে সমস্ত প্রকার গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র, নথি, দলিল-দস্তাবেজ যথাযত ভাবে সংরক্ষণ করা হত । প্রথমে এগুলি নকল করে মোটা খাতায় বাঁধিয়ে রাখা হত । পরে সেগুলি ছেপে বিভিন্ন বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা পুস্তকাকারে রাখা হত । এই কাজটির জন্য যে সরকারি দপ্তর ছিল, তাকে বলা হয় মহাফেজখানা বা লেখ্যাগার । এইসমস্ত নথিপত্র এভাবেই কলকাতা, দিল্লি, বোমই (মুম্বাই), মাদ্রাজ (চেন্নাই) প্রভৃতি বড় শহরে  সরকারি দপ্তরে সংরক্ষিত করা হত । ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা দিল্লিতে অবস্থিত । জেলা স্তর ও প্রশাসনের অন্যান্য নিম্নস্তরেও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংরক্ষিত করে রাখা হত । উল্লেখযোগ্য সরকারি নথিপত্রগুলিকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন — (ক) পুলিশ ও গোয়েন্দার গুপ্ত প্রতিবেদন, (খ) সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন,  (গ) বিভিন্ন সরকারি বিবরণ ও  (ঘ) চিঠিপত্র ।

(ক) পুলিশ ও গোয়েন্দার গুপ্ত প্রতিবেদন : ব্রিটিশ শাসন কালে বিভিন্ন বিদ্রোহে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বৈপ্লবিক কার্যকলাপে সরকার কড়া নজর রাখতেন । পুলিশ ও গোয়েন্দা মারফত এদের খবরাখবর নথিভূক্ত করা হত । এই সমস্ত গোপন বিবরণ ও খবর একমাত্র সরকারি উচ্চপদস্ত আধিকারিক ছাড়া অন্য কারও কাছে প্রকাশ করা হত না । এমনকি ইতিহাসবিদ ও গবেষকদেরও তা সহজে দেখানো হত না । স্বাধীনতার পর এই পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে এবং গোপনীয়তা অনেকটা শিথিল হয়েছে । ব্রিটিশ আমলে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বিভাগের পুলিশ কমিশনার ওল্ডহ্যাম বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে লর্ড কার্জনকে গুপ্ত প্রতিবেদন পাঠান, যার একটি অংশে লেখেন — বঙ্গভঙ্গের ফলে সংখ্যালঘু হিন্দুদের রাজনৈতিক প্রাধান্য অনেক কমে যাবে । ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ সশস্ত্র বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকারের কাছে গুপ্ত প্রতিবেদনে জানায়, সশস্ত্র বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য হল গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো ।

(খ) সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন : দূরবর্তী কোনো অঞ্চলের ঘটনার বিবরণ পাওয়া সহজ ছিল না । সেক্ষেত্রে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ স্থানীয় উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের কাছ থেকে চেয়ে পাঠানো হত । সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদনের কয়েকটি উদাহরণ হল লর্ড বেন্টিঙ্ক- এর আমলে তাঁর আইনসচিব টমাস ব্যবিংটন মেকলে তার প্রতিবেদনে প্রাচ্য শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেন । ভারতছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপকতায় বিধ্বস্ত হয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ইংল্যান্ডে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দিন শেষ হয়েছে এবং পুনরায় এই রকম একটি আন্দোলন শুরু হলে তা মোকাবিলা করার শক্তি সরকারের নেই ।

(গ) বিবরণ : ইংরেজরা বাইরে থেকে এসেছিল বলে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও সমস্যা সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা ছিল না । সেজন্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কর্তারা অনেক সময় বিশেষ প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতেন । প্রশাসনের প্রয়োজনে এইসব বিবরণ পুস্তকাকারে ছাপিয়ে দেওয়া হত । এইসব বিবরণগুলি থেকে আধুনিক ইতিহাস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগৃহিত হয় । দু-একটি বিবরণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন —  নীল বিদ্রোহের পর এই ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য একটি কমিশন গঠিত হয় । কমিশনের পেশ করা বিবরণ থেকে প্রাপ্ত নীল বিদ্রোহের ওপর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ঐতিহাসিকদের ইতিহাসচর্চায় খুব কাজে লাগে । বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ও উত্তর বালেশ্বর জেলায় সাঁওতালদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার জন্য একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়া হয় । তিনিও শতাধিক পৃষ্ঠার বিবরণ পেশ করেন ।

(ঘ) চিঠিপত্র : সরকারি বিভাগের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য সরকারি স্তরে বহু চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হত । এইসব চিঠিপত্র থেকে যেগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেগুলিকে রেখে বাকিগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হত । এই সব চিঠি থেকে বহু অমূল্য তথ্য পাওয়া যায় । দু-একটি চিঠিপত্রের উল্লেখ  করা যেতে পারে, যেমন — ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইংরেজ রাজকর্মচারী অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠি লেখেন । এই চিঠিতে তিনি তাদের দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানসিক উন্নতির লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান । এছাড়া ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বড়োলাট লিনলিথগো ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে আগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে এক চিঠিতে লেখেন  —"আমি এখানে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর সর্বাপেক্ষা গুরুতর বিদ্রোহ দমনে নিমগ্ন আছি ।"

ব্রিটিশ আমলে সরকারের উচ্চপদে ইংরেজরাই নিয়োজিত হতেন । তাই সরকারি প্রতিবেদন ও নথিপত্রে ব্রিটিশ সরকারেরই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হত ।  সেজন্য এই ধরনের উপাদানের ওপর ঐতিহাসিকরা পুরোপুরি নির্ভর করতে পারেন না । তবু আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সরকারি নথিপত্রের ব্যবহার অপরিহার্য ।

***

Comments

Related Items

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা (Critique of Colonial Ideas Regarding Education):-

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনাপর্বে বাংলা তথা ভারতের শিক্ষার্থীরা পাঠশালা, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসা থেকে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি -র মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করত । এসব প্রতি

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (The Bengal Technical Institute) :-

ব্রিটিশ আমলে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে বাংলায় স্বদেশি উদ্যোগে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education)

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education):-

ব্রিটিশ আমলে লর্ড কার্জনের সময় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার পর স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প রূপে দেশীয় প্রগতিশীল স্বদেশী ধাঁচে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রস

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ (Development of Technical Education in Bengal) :-

ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বাংলায় পাশ্চাত্য ধাঁচের কারিগিরি শিক্ষার অস্তিত্ব ছিল না । ঊনিশ শতক থেকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ও বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্

বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute)

বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute):-

ঔপনিবেশিক ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে যেসকল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'বসুবিজ্ঞান মন্দির' বা বোস ইনস্টিটিউট । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু ইংল্যান্ডের র